শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১১ অপরাহ্ন

ব্রিটেনে দক্ষ কর্মী ভিসার আড়ালে মানবপাচার

  • আপডেট সময় শনিবার, ৩ জুন, ২০২৩

যুক্তরাজ্যে স্কিল্ড ওয়ার্কার বা দক্ষ কর্মী ভিসার আওতায় ভুয়া পরিবার সাজিয়ে অভিবাসী পাচার করা হচ্ছে বলে এক তদন্ত উঠে এসেছে। দেশটির সংবাদ মাধ্যম স্কাই নিউজের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য। বিভিন্ন অপরাধ চক্র দক্ষ কর্মী ভিসা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে মানবপাচার ও বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

২৪ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সংগঠিত অপরাধ চক্রগুলো নিজেদের রিক্রুটিং এজেন্সি হিসেবে জাহির করে ব্রিটেনে ভিসা এবং চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোকেদের প্রলুব্ধ করে বিপুল অর্থে হাতিয়ে নেয়।

কিন্তু এসব নেটওয়ার্কের কার্যক্রম এখানেই শেষ নয়। তারা ভিসা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিমানে উঠার আগে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু অথবা ভুয়া স্বামী ও স্ত্রীদের পরিবারের সদস্য দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে যুক্তরাজ্যে পাচার করে দেয়।

যুক্তরাজ্যে দক্ষ কর্মী ভিসা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের তাদের সাথে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসার সুযোগ দেয়া হয়। দেশটিতে বিপুল পরিমান দক্ষ কর্মীর সংকট রয়েছে। কর্মী ঘাটতির এই অভাবকে পুঁজি করে চক্রগুলো ভুয়া ভিসা ও পরিবার ব্যবসা জমিয়ে তুলেছে।

স্কাইনিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শ্রীলঙ্কান অভিবাসী মিসেস এ জানান, আমি কেয়ার ওয়ার্কারের আওতায় দক্ষ কর্মী হিসেবে আসতে একটি রিক্রুটিং এজেন্সিকে ৬৫ হাজার পাউন্ড প্রদান করি।

কিন্তু প্রক্রিয়া শেষে ফ্লাইটে উঠার আগে বিমানবন্দরে আসা এজেন্সির লোকেরা ১২ বছর বয়সি একজন অপ্রাপ্তবয়স্কে হস্তান্তর করেন। যাকে তিনি আগে কখনও দেখেন নি। এজেন্সি উক্ত কিশোরকে ভুয়া সন্তান হিসেবে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যেতে বলে। এজেন্সির সরবরাহ করা কিশোর একটি ভুয়া শ্রীলঙ্কার পাসপোর্ট পরিবহন করছিলেন।

হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর মিসেস এ আর ছেলেটিকে দেখেন নি। বিমান বন্দর থেকেই উক্ত কিশোর উধাও হয়ে যান।

তিনি স্কাই নিউজকে আরও বলেন, “একদম শেষ মুহুর্তে এসব ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। এটা নিয়ে তখন কিছুই করতে পারিনি। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যে আসার পর বুঝতে পেরেছিলাম এটি একটি বড় ভুল ছিল।”

যে কোম্পানি প্রকৃতপক্ষে মিসেস এ-কে স্পনসর করেছিল তারা জোর দিয়ে জানায়, তারা কোনো ভুল করেনি এবং শ্রীলঙ্কায় অবস্থানরত তৃতীয় পক্ষ এবং তথাকথিত এজেন্সির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

স্কাইনিউজের প্রতিবেদক লিসা হল্যান্ড প্রতিবেদন নিয়ে আয়োজিত একটি পডকাস্ট সাক্ষাত্কারে বলেন, “হাই স্কিল্ড ভিসায় চাকরির জন্য আসাদের অধিকাংশ নিজেদের সাথে ভুয়া পরিবার এনে এক ধরণের পাচারকারীতে পরিণত হয়েছিল।”

আবার এসব ভিসায় আসা ব্যক্তিদের অনেকেই দক্ষ কর্মী ছিলেন না। এই ভিসার জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য লোকেরাও টাকার বিনিময়ে চক্রগুলোর সহায়তায় যুক্তরাজ্য এসেছেন।

নানা কৌশলে পাচার

অন্য একটি পৃথক ঘটনায় আরেক শ্রীলঙ্কান নারী স্কাই নিউজকে বলেন, তিনিও দক্ষ কর্মী হিসেবে কাজের ভিসায় লন্ডনে এসেছিলেন। তিনি তার স্বামী এবং সন্তানের পরিচয় দিয়ে তিনজনকে নিয়ে এসেছিলেন।

এই নারীকে আর খুঁজে পাওয়া না গেলেও তার সাথে আসা ভুয়া পরিবারটিকে খুঁজে পেয়েছে স্কাইনিউজ। তিনি ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের স্টাফোর্ডশায়ারে বসবাসকারী ৪৮ বছর বয়সি আরেক শ্রীলঙ্কান। ধান চাষী রাথা নামের উক্ত ব্যক্তি দক্ষ কর্মী ভিসায় আসা নারীর সাথে ভুয়া পরিচয়ে এসেছিলেন।

রাথা দাবি করেন, তিনি যুক্তরাজ্যে আসতে একজন এজেন্টকে ৫০ হাজার পাউন্ড বা ৫৭ লাখ টাকা প্রদান করেছেন। এজেন্ট তাকে একটি চাকরি এবং বছর দুয়েক পরে স্থায়ী বৈধতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

রাথার সাথে তার ছেলে হিসেবে আসা হিন্থুজান তার আত্মীয়দের সাথে এখন লিভারপুলে থাকেন। হিন্থুজানের পরিবার তাকে যুক্তরাজ্যে আসার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু কলম্বোর বিমানবন্দরে না পৌঁছানো পর্যন্ত অপরিচিত ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল হওয়ার ভান করতে হবে সেটি তিনি আগে থেকে জানতেন না।

রাথা এবং হিন্থুজান দুজনই যুক্তরাজ্যে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করছেন।

শ্রীলঙ্কা থেকে ব্যাপকহারে দেশত্যাগ

গত বছর শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটিকে দেউলিয়া ঘোষণা দিয়েছিলেন।

অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং শ্রীলঙ্কার রুপির দর পতনের পর দেশটির নাগরিকেরা প্রতিবেশী ভারতে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত মহাসাগরের ফরাসি দ্বীপগুলোসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে যাত্রা শুরু করে।

দ্য ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, শ্রীলঙ্কার ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ নাগরিক ২০২২ সালে চাকরির উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেছে। যাদের বেশিরভাগই নিম্ন-দক্ষ এবং আধা-দক্ষ কর্মী। এই বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে গেছেন আরও ৭৩ হাজার শ্রীলঙ্কান।

অবৈধ উপায়ে বৈধ পথ

যুক্তরাজ্য ব্রেক্সিটের পর সৃষ্ট ব্যাপক কর্মী ঘাটতি এবং অবসরে যাওয়া লোকের হার বেড়ে যাওয়ায় সরকার দক্ষ কর্মী ভিসায় লোক আনার সুযোগ দিয়েছে। এটির উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন সেক্টরে শ্রম ঘাটতি জরুরীভাবে পূরণ করতে নির্দিষ্ট দক্ষতা সম্পন্ন বিদেশি কর্মীদের আকৃষ্ট করা।

যুক্তরাজ্যের সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে ১১ লাখ শূন্যপদ ছিল। যা দেশটির মোট বেকার লোকের সংখ্যার সমান। একই সময়ে স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে দুই লাখ আট হাজার সর্বোচ্চ সংখ্যক শূন্যপদ ছিল।

মিসেস এ একজন কেয়ার কর্মী হিসাবে চাকরির আবেদনের সমর্থনে নথি জমা দিয়েছিলেন। তিনি একটি নার্সিং ডিপ্লোমা এবং বিশদ জীবনবৃত্তান্ত জমা করেছিলেন। যেখান তিনি দুই বছর ধরে একটি কেয়ার হোমে কাজ করেছেন বলে উল্লেখ করে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাথমিক চিকিৎসার যোগ্যতা রয়েছে বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। তিনি বৃত্তান্তে আরও জানান, শ্রীলঙ্কার একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার ইংরেজিতে বেশ ভালো একটি কোর্স করা আছে।

প্রকৃতপক্ষে, মিসেস এ ইংরেজি বলতে পারেন না। মিসেস এ-এর আইনজীবী স্কাই নিউজের কাছে দাবি করেন, ভিসার জন্য জমা দেয়া সমস্ত নথি মিথ্যা ছিল। এগুলো এজেন্টদের সরবরাহ করা।

ব্রিটিশ হোম অফিসের প্রতিক্রিয়া

স্কাইনিউজের তদন্তে আরও জানা গেছে, ভুয়া নিয়োগকারীরা স্থায়ী বসবাসের পথ সহ দক্ষ কর্মী ভিসার প্রতিশ্রুতি দেয়। একবার প্রলুব্ধ হয়ে গেলে, তারা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পুরো প্রক্রিয়া বেশ সূক্ষ্ম ও জটিল বলে ভীতি প্রদর্শন করে। দীর্ঘ আবেদন প্রক্রিয়ার পুরোটাই ইংরেজিতে করতে হবে এমন ভয়ও দেখানো হয়।

সাংবাদিক লিসা হল্যান্ড বলেন, “এটি বেশ দ্রুত এবং অনেক সময় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও পরিচালিত হয়। আমরা কয়েক ডজন বার্তা দেখেছি যেখানে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে স্পনসরশিপের একটি প্রশংসাপত্র সরবরাহ করা হয়েছে।’

একবার টাকা হস্তান্তর করা হলে এবং কাগজপত্র তৈরি সম্পন্ন হয়ে গেলে সম্ভাব্য অভিবাসীদের বায়োমেট্রিক দিতে ইউকে ভিসা পরিষেবা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে ভিসা হয়ে গেলে আবেদনকারীদের সাথে অন্য ব্যক্তিদের জুড়ে দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয় পাচারকারীরা।

স্কাইনিউজের প্রতিবেদনের পর এক বিবৃতিতে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের হোম অফিস। সংস্থাটি জানায়, “আমরা প্রতিবেদনের দাবিগুলো তদন্ত করছি। অভিবাসন ব্যবস্থার অপব্যবহার সহ্য করা হবে না। যারা মিথ্যা নথি ব্যবহার করেছেন এবং ব্যক্তিগত পরিস্থিতিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন বা অন্য কোনো উপায়ে প্রতারণা করেছেন তাদের সবার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে।”

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com