‘আমরা মুক্ত জীবনের জন্য ভ্রমণ করি না; কিন্তু জীবনের জন্য আমরা মুক্ত হই।’ ভ্রমণ মনকে প্রফুল্ল করে, এনে দেয় প্রাণশক্তি। ভ্রমণ করতে পছন্দ করে না বা নতুন জায়গায় ঘুরতে যেতে চায় না- এরকম মানুষের সংখ্যা খুবই কম। বছরের এ সময়টা ভ্রমণের জন্য অধিক উপযোগী, তাই অনেকে সারাবছর ভ্রমণ না করতে পারলেও অন্তত বছরের শেষদিকে বেরিয়ে পড়েন কাছে-দূরে কোথাও ঘুরে আসতে। কাছের কোনো রিসোর্ট হোক বা দেশের ভেতরের যে কোনো জায়গা বা দূর দেশে অজানা জায়গায়। ভ্রমণ আনন্দপূর্ণ করতে আপনাকে আগে থেকেই কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে, জানতে হবে সেই জায়গা সম্পর্কে অজানা তথ্য।
ভ্রমণ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কিছু ভ্রমণ শুধুই অবসর যাপনের উদ্দেশ্যে আর কিছু ভ্রমণে হিলট্র্যাক, হেঁটে লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার বিষয় থাকে। তাই ভ্রমণের ধরন বুঝে আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক নির্বাচন করুন। তবে খুব বেশি পোশাক নিয়ে অধিক ব্যাগ বানানো ও অন্যান্য জিনিস নেওয়ার সুযোগ বন্ধ না করে ফেলাই ভালো। জুতা হওয়া চাই আরামদায়ক। যেহেতু ভ্রমণ মানেই নতুন জায়গা আবিস্কার ও ঘুরে বেড়ানো- তাই আরামদায়ক জুতা হলে ভালো হয়।
ভ্রমণের পরিসর, জায়গা ও আবহাওয়া বুঝে ব্যাগ নির্বাচন বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। কোথায় যাচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় জিনিসের পরিমাণ কেমন হতে পারে, তা নির্ধারণ করে খুব বাড়তি জিনিস না নিয়ে ব্যাগের সাইজ নির্ধারণ করে ফেলুন। কম সময়ের ভ্রমণের জন্য ট্রাভেল ব্যাগ যথেষ্ট হলেও দূরের ভ্রমণ ও বেশিদিনের জন্য যেতে চাইলে ট্রলিব্যাগ প্রয়োজন। তবে অতিরিক্ত বড় ব্যাগ ডেকে আনতে পারে হাজারো ঝক্কি-ঝামেলা। তাই ব্যাগ নির্বাচনে একটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ব্যাগ কেনার সময় সচেতনতা অবলম্বন করুন। ব্যাগ তৈরির উপাদান ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিন। পানিরোধক কি-না যাচাই করে নিন। পানিরোধক ব্যাগে কাপড় ও অন্যান্য জিনিস নিরাপদ থাকে। প্যারাসুট কাপড়ের ব্যাগ নিতে পারেন।
পোশাকে বাড়তি আড়ম্বর এড়িয়ে চলুন ভ্রমণে। পরিবহনে সহজ ও ব্যাগে কম জায়গা লাগে এরকম পোশাক নির্বাচন করুন। অবশ্যই আরামদায়কতা থাকবে সবার আগে। শীতের ভ্রমণে গরম কাপড় আর রঙিন কাপড় থাকতে হবে। ফ্যাশনেবল ও সময় উপযোগী হলে ভ্রমণের সময়ের ছবিগুলো সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকবে। ভ্রমণের পোশাক হতে পারে ডেনিম শার্ট, পালাজ্জো, লুজ প্যান্টস, টি-শার্ট, জ্যাকেট, হুডি, পঞ্চ, ডেনিম জ্যাকেট, উলের ট্রেন্ডি কাটের টপস ইত্যাদি।
ভ্রমণে যাওয়ার আগে নিজের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিন, যেগুলো খুবই গুরুত্ব বহন করে। নিজের হ্যান্ডব্যাগে ট্রাভেল সাইজের প্রসাধনী (ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্য) ফেস ওয়াশ, টুথ ব্রাশ, টুথ পেস্ট, চিরুনি, বডি স্প্রে, হেয়ার ক্রিম, বাড়তি জুতা, স্যান্ডেল, যাত্রাপথে পড়ার জন্য ম্যাগাজিন, বই ইত্যাদি। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ক্যামেরা সঙ্গে যা যা নিতে চান তা ঠিক করে প্রয়োজনীয় চার্জার ও পাওয়ার ব্যাংক নিতে পারেন। যে কোনো জায়গায় চার্জ দেওয়ার জন্য পাওয়ার ব্যাংক নিতে পারেন। আর এসব ডিভাইস অবশ্যই পানিরোধক ব্যাগে রাখতে হবে।
নতুন শহর দেখার একটা উত্তেজনা থাকে, সঙ্গে থাকে অজানা জায়গায় সব কিছু খুঁজে পাওয়ার চিন্তা। ওয়ালপেপার সিটি গাইড কিনে রাখতে পারেন। ওয়ালপেপার সিটি গাইডে যে কোনো শহরের খুঁটিনাটি বিস্তারিত বর্ণনা থাকে। এতে আপনি যে কোনো শহরের রেস্টুরেন্ট, হোটেল ও দর্শনীয় জায়গার খোঁজ পাবেন। বহন করাও সহজ। মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করতে পারেন। প্রতিনিয়ত টিপস দেবে। এ ছাড়া দেশের বাইরে ভ্রমণের জন্য সবার আগে নির্ধারিত পরিকল্পনার এয়ারলাইন্সের অগ্রিম টিকিট কিনে রাখলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। একাধিক শহরে ভ্রমণ পরিকল্পনা থাকলেও অগ্রিম টিকিট করে রাখা ভালো। অনলাইনে হোটেল বুকিং ও ব্যাগ চেকিং পেমেন্ট দিয়ে রাখতে পারেন। এতে করে ঝক্কি-ঝামেলা কম হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভিন দেশে ভ্রমণে প্রয়োজন হয় সে দেশের লোকাল কারেন্সি। ইউএস ডলার বহন করলে তা সে দেশের এয়ারপোর্ট, হোটেল বা নিকটস্থ মানি এক্সচেঞ্জ বুথ থেকে নিতে হয়।
দেশের মধ্যে খুব দূরে বা কাছে ঘুরে আসতেও বাস, ট্রেন, লঞ্চ, এয়ারলাইন্সের অগ্রিম টিকিট কিনে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া খুব প্রয়োজন। ব্যক্তিগত পরিবহনে গেলে অবশ্যই গাড়ি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খুব দক্ষ চালক নিয়ে যেতে হবে, যেহেতু হাইওয়েতে চালাতে হয়।
ভ্রমণের সময় স্বাস্থ্য ভালো থাকা জরুরি। যেহেতু অনেক স্বপ্ন ও পরিকল্পনা থাকে একেকটি ভ্রমণ নিয়ে। ‘মোশন সিকনেস’ খুব পরিচিত একটি সমস্যা। এর ভয়ে অনেকেই ভ্রমণ করতেই চান না। বমি ভাব হয় ও মাথা ঘুরে। এর থেকে কিছুটা পরিত্রাণ দিতে পারে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা। রেলপথে ভ্রমণ সড়কপথের চেয়ে আরামদায়ক এ ধরনের সমস্যা আক্রান্তদের জন্য। চোখ বুজে থাকুন বা ঘুমানোর চেষ্টা করতে পারেন। বই পড়া ও একদিকে তাকিয়ে থাকা থেকে বিরত থাকুন। হঠাৎ শুরু হতে পারে এ রকম অসুখের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ বহন করুন। ট্রাভেলার্স ডায়রিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, এসিডিটি, জ্বর, মাথাব্যথার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সঙ্গে বহন করুন।
ভ্রমণে সব সময়ই কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। মানিব্যাগ, সেলফোন ও অন্যান্য জিনিস, ব্যাগ খুব সাবধানে রাখুন। সব টাকা মানিব্যাগে না রেখে কিছু অন্য জায়গায় ভাগ করে রাখুন এবং কার্ড ব্যবহার করতে পারেন। অচেনা জায়গায় যেতে ট্যুর গাইডকে সঙ্গে নিন এবং তাদের নির্দেশনা অনুসরণ করুন। খুব বেশি রাত পর্যন্ত একা বাইরে না থাকাই উত্তম।
ভ্রমণের ১০ টিপস
– ইলেকট্রনিক্সের বিষয়ে সচেতন হোন। ফোনে যথেষ্ট পরিমাণ চার্জ রাখুন। সঙ্গে পাওয়ার ব্যাংক আপনাকে চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবে। ক্যামেরার জন্য অন্ততপক্ষে একটি অতিরিক্ত ব্যাটারি রাখুন। ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারের আগে নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবুন।
– আপনি যেখানে যাচ্ছেন, সে স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নিন। গুগল ম্যাপ হতে পারে আপনার জন্য বেশ উপকারী। বেড়াতে গিয়ে কাছে পিঠে হেঁটে ঘুরে নিলে জায়গা সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ ধারণা খুব সহজেই আপনি পাবেন।
– ভ্রমণের জন্য অতি জরুরি পণ্য ভাগ করে নিন। জরুরি পণ্যগুলোকে আলাদা ব্যাগে বহন করুন। সাধারণ সব ব্যাগের সঙ্গে না রেখে নিজ হাতে বহন করুন। এক্ষেত্রে ব্যাক প্যাক হতে পারে আপনার উপযুক্ত সঙ্গী।
– আপনার হোটেলের বিস্তারিত তথ্য জানুন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে হোটেলের নাম-ঠিকানা এবং ফোন নম্বর লিখে নিজের সঙ্গে রাখুন এবং ব্যাগের সঙ্গে সংরক্ষণ করুন।
– সব ধরনের ক্যাশ টাকা এক সঙ্গে না রেখে দলের সবার কাছে ভাগ করে রাখুন। অথবা আলাদা ব্যাগে গুছিয়ে নিন। এতে আকস্মিকভাবে কোনো সদস্যের টাকা হারিয়ে গেলেও সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে।
– ভ্রমণ পরিকল্পনার পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্ধারিত বাহনের টিকিট নিয়ে নিন। দেরি করার কারণে অতিরিক্ত মুদ্রা এবং ঝক্কি দুই-ই তৈরি হতে পারে।
– পোশাক নির্বাচনের সময় আবহাওয়া, আরামদায়কতা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়দের সামাজিক মূল্যবোধকে বিবেচনায় রাখুন। তাতে ভ্রমণ হবে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যময়।
– নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে নিন। প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকদিনের বেশি ওষুধ নিয়ে নিন। বাড়ি ফিরতে পরিকল্পনার বাইরে সময়ের দরকার হলেও যেন ওষুধের কমতি না হয় সেদিকে নজর দিন।
– ভ্রমণের নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন থাকুন। স্থান পরিভ্রমণের আগে কোনো প্রকার সতর্কবাণী আছে নাকি দেখে নিন। জরুরি যোগাযোগ নম্বর মনে রাখার চেষ্টা করুন।
– পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনা খাবার সঙ্গে রাখুন। তবে মনে রাখবেন, ঘুরতে গিয়ে স্থানীয় খাবার উপভোগ করা আপনার গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হিসেবে সঞ্চিত থাকবে।