শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১০:১২ অপরাহ্ন
Uncategorized

চীনের দূঃখ হোয়াংহো নদী

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২২

হলুদ নদী শুনলেই মনে পড়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ বয়সে রচিত হলুদ নদী সবুজ বন বইটির কথা। কিন্তু আজকে আমি বইটির রিভিউ নয়; আলোচনা করব দৈর্ঘের দিক থেকে এশিয়ার দ্বিতীয় এবং পৃথিবীর ৬ষ্ঠ বৃহত্তম নদী হোয়াংহো (Hoang Ho) সম্পর্কে। যাকে চীনের দূঃখ বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীনকালে হোয়াংহো নদীর অববাহিকায় পশুচারণ ভূমি অত্যন্ত উর্বর ছিলো। আর সেই কারনেই চীনের প্রাচীন সভ্যতা অর্থাৎ চৈনিক সভ্যতা এই নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। তাই হোয়াংহো নদীর অববাহিকাকে চীনের সভ্যতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির লালনাগর বলা হয়।

হোয়াংহো নদীর নামকরণ নিয়ে এই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে একটি লোক-কাহিনী প্রচলিত আছে। বলা হয়, কোন এক সময় এই নদীর তীরবর্তী একটি গ্রামে একটি লোক বাস করতো। তার একটি মেয়ে ছিলো যার নাম ছিল হোয়াংহো। একদিন ওই এলাকার অত্যাচারি শাসক মেয়েটিকে মেরে নদীতে ফেলে দেয় এবং সবাইকে বলে মেয়েটি নৌকায় পার হওয়ার সময় পানিতে ডুবে মারা গেছে। এই কথা শুনে মেয়েটির বাবা হন্য হয়ে তার মেয়েকে খুজতে থাকে আর হোয়াংহো… হোয়াংহো….. বলে ডাকতে থাকে। সেই থেকেই মেয়েটির নাম অনুসারে এই নদীর নাম হয় হোয়াংহো।

কিন্তু আদতে এই নদীর নামকরণের ইতিহাসটা ভিন্ন। হোয়াংহো একটি চায়নিজ শব্দ। হোয়াং অর্থ হলুদ আর হো অর্থ নদী অর্থাৎ হোয়াংহো অর্থ হলুদ নদী। চীনের একমাত্র এই নদীকে হো বলা হতো অন্যগুলিকে ছুয়ান বা শুই বলা হতো। ছুয়ান অর্থ পর্বতের নদী, যা সাধারণ নদীর চেয়ে ছোট। আর শুই মানে পানি।

দুই হাজার বছর পূর্বে অর্থাৎ সভ্যতা বিকাশের প্রাক্কালে মানুষ যখন এই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের প্রচুর গাছ-পালা কাটতে থাকে তখন এখানকার ধূসর হরিদ্রার বর্ণের মাটি এই নদীর পানির সঙ্গে মিশে হলুদ বর্ণের সৃষ্টি করে আর সেই থেকেই এই নদীর নাম হয় হোয়াংহো। এটিকে ইংরেজিতে Yellow River বলা হয়।

হোয়াংহো নদীর অপর নাম হলো পীত নদী। কারণ নদীটি কুনলুন পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে পীত সাগরে পতিত হয়েছে। আর যতোদূর জানা যায় পীত সাগরের নামকরণও হয়েছিলো তার হলুদ পানির কারণে। হোয়াংহো নদী ছিংহাই, সিছুয়ান, গানসু, নিংশিয়া, অন্তর্দেশীয় মঙ্গোলিয়া, শানসী, হোনান আর শান্দোং এই নয়টি প্রদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই নদীর তীরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ শহর বন্দরগুলো হলো, লানযে, বাওথৌ, যেমষ্ঠে, জিনোন প্রভৃতি। এই নদীর দৈর্ঘ ৫৪৬৪ কিঃ মিঃ (৩৩৯৮) মাইল। আকাশ থেকে হোয়াংহো নদীকে চীনা “” অক্ষরের মতো দেখায়।

প্রাচীন চীনে প্রায়ই হোয়াংহো নদী থেকে বন্যার সূত্রপাত হতো। ইতিহাসের ভাষ্য অনুযায়ী এই নদী অতি প্রচন্ডভাবে ২৬ বার নিজের গতিপথ বদলেছে। এর ফলে চীনের জনগন ভোগ করেছে অবর্ণনীয় দূঃখদুর্দশা। আর এই কারণেই হোয়াংহো নদীকে চীনের দূঃখ বলা হয়

এছাড়াও প্রাচীন চীনের কিছু লোক-কাহিনীতে দূঃখ-দূর্দশার কারণরূপে হোয়াংহো নদীর নাম পাওয়া যায়। হোয়াংহো নদীর তীরবর্তী ইয়েদি নামক গ্রামের অধিবাসীরা সি মেন পাও এর কাছে তাদের সবথেকে বেশি দূঃখের কারণ হিসেবে হোয়াংহো নদীর কথা উল্লেখ করেন। তারা মনে করতেন হোয়াং হো নদীর দেবতা নদীতেই থাকে; প্রতি বছর দেবতা নতুন স্ত্রী চায়। স্থানীয় অধিবাসীরা যদি দেবতার জন্য প্রতি বছর স্ত্রী যোগাড় না করে দেয় তবে তিনি ক্ষুব্ধ হবেন এবং গোটা অঞ্চলের অধিবাসীদের বন্যার পানিতে ডুবিয়ে দেবেন।

আর তাই দীর্ঘকাল ধরে স্থানীয় সরকার ও ডাকিনীরা সোতসাহে হোয়াংহো দেবতার জন্য তথাকথিত স্ত্রী বেছে নেয়ার কাজ করতেন এবং এই সুযোগে অধিবাসীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করতেন। হোয়াংহো নদীর বন্যার ভয়ে চীনের মানুষ যে কতটা সন্ত্রস্ত ছিলো তার ইঙ্গিত এমন অনেক লোক-কাহিনীর মধ্যে নিহিত রয়েছে।

নয়া চীনে সরকারি উদ্যোগে হোয়াংহো নদীর উজানের দিকে ও মধ্য এলাকা বরাবর মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন কতকগুলো জ্বল সংরক্ষ্ণ প্রকল্প নির্মান করায় এবং ভাটির দিকে নদীর পাড়ের ভেড়িগুলোকে আরো মজবুত করায় বিংশ শতাব্দীতে এসে নদীর তীরবর্তী জনসাধারণের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়েছে। আর তাই চীনের মানুষ এখন আর হোয়াংহো নদীকে দূঃখের কারণ না বলে চিনা সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে চিন্তা করতেই বেশি সাচ্ছন্দ বোধ করেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com