শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪৩ অপরাহ্ন
Uncategorized

রাজস্থানের এক কেল্লা লোটওয়ারা। লোকে বলে পিকক টাউন।

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

 গুড মর্নিং, …. কনকনে ঠান্ডায় গরম লেপের তলা থেকে কোনওমতে চোখ বার করে দেখি দরজায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে একজোড়া ইয়াবড় ঘোরানো গোঁফ আর পাগড়ি পরা বাদল সিংহ। সাত সকালে ঘুম ভেঙে হঠাৎ এই দৃশ্য দেখে প্রথমে অবাক হয়ে গেলাম। ঘুমের রেশ কাটতে অবশ্য সময় লাগেনি। ডিসেম্বর মাসের কনকনে ঠান্ডায় রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামের রাজবাড়ির বিলাসবহুল বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় আদা-চায়ে চুমুক দিতে দিতে সত্যি নিজেকে রাজা মহারাজার চেয়ে কিছু কম মনে হচ্ছিল না।
বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছি দিল্লি থেকে খুব বেশি দূরে নয় অথচ অন্য রকম একটু অজানা কোনও জায়গায় এবারে ক্রিসমাসের ছুটি কাটাব। কোথায় যাই ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একদিন একটি ট্র্যাভেল ওয়েবসাইটের একটা ছবিতে চোখ আটকে গিয়েছিল। ইন্টারনেটে একটু খোঁজ করতেই মনে হল এই তো ঠিক এরকমই তো একটা জায়গা খুঁজছিলাম। দিল্লি থেকে মাত্র ২৬০ কিলোমিটার দূরে আর ভরতপুর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে রাজস্থানের ছোট্ট গ্রাম লোটওয়ারা। এর আর-এক নাম, রাজস্থানের ‘পিকক টাউন’। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা আকর্ষণ করল, অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা নাকি লোটওয়ারা কেল্লার মধ্যেই।

এমনিতেই উত্তর ভারতের জানুয়ারি মাসের ঠান্ডা। তারপরে এই বছরে ঠান্ডার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘন কুয়াশা। ভোরবেলা কাঁপতে কাঁপতে কোনওমতে গাড়িতে চেপে বসতেই দেখলাম রাজধানীও যেন সাদা লেপের তলায় ঢুকে ঘুম দিচ্ছে। ঘন কুয়াশায় প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না বললে চলে। সে যাই হোক, অজানা উত্তেজনা আর ছুটির আনন্দে গাড়িতে বসতে না বসতেই সবার ঘুম কোথায় হাওয়া। একটু পরেই অবশ্য কুয়াশা কেটে গিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল সোনালি সূর্যের আলো, বাইরে শীতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া। গাড়ি ছুটে চলল ঝকঝকে তাজ এক্সপ্রেসওয়ে ধরে। এর মধ্যেই রাজবাড়ি থেকে দু’বার ফোন এসে গেছে আমরা ঠিক যাচ্ছি কিনা, কোথায় আছি ইত্যাদি খবর নেওয়ার জন্য। ওঁদেরই নির্ভুল নির্দেশ অনুযায়ী ভরতপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার মতো যাওয়ার পরেই হাইওয়ে ছেড়ে গাড়ি নামল গ্রামের মাটির রাস্তায়। গাড়ির কাচ নামাতেই মন জুড়িয়ে গেল ঠান্ডা হাওয়ায় আর নাকে এল অদ্ভুত সুন্দর মিষ্টি একটা গন্ধ (অনেকটা বাংলার গন্ধরাজ লেবুর মতো)। হঠাৎ, আমাদের দলের সবথেকে ক্ষুদে সদস্য গোগোলের চিৎকারে আমরা সবাই বাইরের দিকে তাকালাম, ‘‘দিদান দেখো ময়ূর!’’ অবশ্য এরপরে এই কথাটা বেচারাকে দুদিন এতবার বলতে হয়েছে সেও শেষের দিকে আর ডাকাডাকি না করে ছবি তুলতেই ব্যস্ত ছিল। সত্যি ‘পিকক টাউন’ই বটে, রাজস্থানে ময়ূর দেখতে পাব সে তো আমরা সবাই জানতাম, কিন্তু তা বলে এরকম ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূর বাড়িতে, উঠোনে, রাস্তায়— আগে কখনও দেখিনি।

আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা, বেশিরভাগই কাঁচা বাড়ি, মহিলারা রাজস্থানী রং-বেরঙের পোশাকে দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত। একটা মোড় ঘুরতেই দেখতে পেলাম ফোটের উঁচু লাল পাথরের পাঁচিল। বিশালকায় কাঠের প্রধান দরজা দিয়ে গাড়ি ভিতরে ঢুকতেই সামনে দেখি দাঁড়িয়ে আছেন এক রাজকীয় ব্যক্তিত্ব। জমকালো নাগরা জুতো, সাফারি সুট, কালো ওভারকোট। একজোড়া মোটা সাদা-কালো ঘোরানো গোঁফের নীচে অমায়িক হাসি। পিছনে দাঁড়ানো আরও চার-পাঁচজন। এগিয়ে এসে পরিচয় দিলেন স্বয়ং ঠাকুর গিরিরাজ সিংহ লোটওয়ারা। পরিচয়পর্ব সেরে বলে গেলেন, ‘‘আপনারা বিশ্রাম নিন, দেখা হবে বিকেল বেলায় গল্প হবে বনফায়ার এর পাশে বসে।’’ রাজকীয় অথচ পরিমার্জিত ব্যবহার, ভদ্রতাবোধ আর উষ্ণতা ওই কয়েক মুহূর্তেই আমাদের মন জয় করে নিয়েছিল।

ভিতরের দরজা দিয়ে ঢুকতেই সামনে বিশাল ছাদ খোলা উঠোন। সেখানে দাঁড়িয়ে বাড়ির মহিলারা। আরেকপ্রস্ত সম্বর্ধনা আর পরিচয়পর্ব। অবশ্য প্রত্যেকেরই মুখে টানা লম্বা ঘোমটা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে এসে একতলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা। ভিতরে ঢুকেই আবার অপ্রস্তুত হওয়ার পালা। বিশাল বড় বড় দুটো শোওয়ার ঘরের মাঝখানে রয়েছে রাজকীয় ডাইনিং রুম। ফার্নিচার থেকে শুরু করে, ক্রকারি, কার্পেট, লাইটস সমস্ত কিছুর মধ্যেই রয়েছে ইতিহাস ও আধুনিকতার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। ঠিক গল্পে পড়া অথবা দূর থেকে ছবি তোলা রাজস্থানের কেল্লা সত্যি সত্যি এই দুদিন আমাদের বাড়ি, ভাবতেই গা শিরশির করে উঠল।

একটু বিশ্রাম নিয়েই বাড়ির ভিতরটা ঘুরে দেখব ঠিক করলাম। ৫২,৩০০ স্কোয়ার ফুট জমির উপরে তৈরি এই সুন্দর ছিমছাম রাজবাড়ি যেন সত্যিকারের কোনও বলিউড সিনেমার সেট। কেল্লার চারদিকে বিশাল উঁচু পাথরের প্রাচীর। ভিতরে ছড়ানো ২০টার বেশি ‘অতিথি গৃহ’, দুই তলায় রয়েছে ‘কিংস রুম’, ‘কুইন্স রুম’ একতলায়, চারটে ‘প্রিন্সেস রুম’ গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে ডিলাক্স রুম”( সেগুলো আমাদের মতো কোনো গেস্ট এলে ব্যবহার করা হয়)। একদিকে সপ্তদশ শতাব্দীর কারুকার্য অন্যদিকে প্রত্যেকটি রুমে লাগানো আছে এসি, আধুনিক স্নানঘর অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। সবথেকে আকর্ষনীয় লাগল বাড়ির এই অংশের ঠিক মাঝামাঝি বড় উঠোনের মতো একটা জায়গা, ‘কাচেরি’ বা ‘কোর্ট্-রুম’। আজও নাকি গ্রামের লোকেরা নির্দিষ্ট দিনে এখানে জড়ো হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করে।

অন্ধকার হতেই ঠান্ডার প্রকোপ আরও অনেক গুণ বেড়ে গেল। এই সময় তাপমাত্রা নাকি এক থেকে দু ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়। ঘন কুয়াশায় কেল্লার বৈদ্যুতিক লাইট যেন আরও রহস্যময় লাগছিল। এমন পরিবেশে বন ফায়ারের চারদিকে গোল হয়ে বসে আমরা গল্প শুনছিলাম। গল্প বলছিলেন ঠাকুর গিরিরাজ সিংহ। কিছুটা ঐতিহাসিক তথ্য কিছুটা পারিবারিক এবং লোকমুখে প্রচলিত পুরাণ বা কাল্পনিক গল্প— সব মিলিয়ে এই সুদূর রাজপুত রাজ্যের অজানা ইতিহাস যেকোনও লেখক বা কবির জন্য অমূল্য রসদ।

জানলাম মরুভূমির দেশে এই ছোট্ট গ্রামে শুধু প্রচুর সবুজ গাছপালা আর ফল মূল এর ভান্ডার আছে তাই নয়, অনেক ধরনের বন্যপ্রাণী- যেমন হরিণ, লেপার্ড, লেঙ্গুর, নীলগাই ইত্যাদিও যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়। তার প্রধান কারণ এই গ্রামটি ঘিরে থাকা এক পৌরাণিক নদী-বান-গঙ্গা! মহাভারতের যুদ্ধে ভীষ্ম যখন আহত এবং তৃষ্ণার্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন, অর্জুন তার বাণ ছুড়ে এখানেই মাটির ভিতর থেকে জল বার করেন। সেই থেকেই সৃষ্টি এই ‘বাণ গঙ্গা’র। নদীর আর কোনও অস্তিত্ব না থাকলেও মাটির উর্বরতা এই অঞ্চলের গাছপালা-প্রকৃতিকে অনেকটাই প্রভাব ফেলেছে। ১৭০০ শতাব্দীতে এই ফোর্ট তৈরি করেছিলেন ঠাকুর গঙ্গা সিংহ লতোয়ারা। সেই বংশেরই এখনকার রাজা হলেন গিরিরাজ সিংহ। ইনি শুধু উচ্চশিক্ষিত ও নিতান্ত ভদ্রলোক তাই নয়, শুনলাম ইনি গ্রাম ও গ্রামের লোকেদের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেছেন।
গরম গরম মক্কে কি রোটি, সরসো কা সাগ আর স্থানীয় সবজি কের সাঙ্গির দিয়ে আমরা ডিনার সারলাম। রানি সাহেবা নিজে দাঁড়িয়ে শুধু তদারকি করলেন তাই নয়, এও জানালেন কাল নাকি লাঞ্চের মেনুতে থাকবে রাজস্থানের বিখ্যাত লাল মাস।

পরের দিন সকালে বাদল সিংহের রেখে যাওয়া চায়ে চুমুক দিতে দিতেই খবর এল আমাদের একটু পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে। গিরিরাজ সিংহ আমাদের নিয়ে যাবেন চান্দ বাউরি অভানেরি। ব্রেকফাস্ট সেরেই হইহই করে বেড়িয়ে পড়লাম আমরা সবাই। গ্রামের মানুষ যথারীতি দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত। রাজা দেখালেন ওনার ই তত্ত্বাবধানে তৈরি পলিটেকনিক কলেজ, ছোটদের স্কুল, রাধাকৃষ্ণ মন্দির। তবে আসল আকর্ষণ নিঃসন্দেহে চান্দ বাওরি। অনেকেরই অজানা অষ্টম শতাব্দীতে তৈরি এই বাওরি পৃথিবীর সবচেয়ে বিশালাকায় বাওরি মধ্যে একটা এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। ঠিক যেন রুক্ষ মাটি আর সবুজে ঘেরা একখণ্ড ইতিহাস। অনন্ত কাল থেকে যেন পাহারা দিচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূরের দল। ৬৫ ফুট গভীর ১৩ তলা এই স্থাপত্য সত্যিই অবাক করে দেয়।

প্রাণভরে ছবি তোলার পালা শেষ করে আমরা রওনা দিলাম। কাছাকাছি আর-এক দেখার জায়গা মেহেন্দিপুর বালাজি টেম্পল। তবে, এবারে সবাই ফিরে যাওয়াই ঠিক করলাম। ওদিকে আবার লাল মাস অপেক্ষা করে আছে।

রাজবাড়িতে আমাদের শেষ সন্ধে যে এই ভাবে কাটবে আমরা কেউই ভাবতে পারিনি। বিকেলে চায়ের সঙ্গে ফুলকপির পকোড়া খেতে খেতে খবর পেলাম বাড়ির মহিলারা রাজস্থানি গান বাজনার আয়োজন করেছেন। অন্ধকার হতেই ঝলমল করে উঠল বাড়ির উঠোন। অজানা অদূরে অসময়ে যেন এক অদ্ভূত দীপাবলির আনন্দে মেতে উঠলাম আমরা। রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে সুর উঠল… নিম্বুরা তোরান গ্যাই বাগ ম্যায়…। সবাই মিলে নাচ গান বাজনায় কখন যে ডিনারের সময় হয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি।
সকাল বেলা ফেরার পালা। সত্যি কখনোই মনে হয়নি আমরা বেড়াতে এসেছি। যেন দুদিন আমরা রাজপুতানার ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছিলাম। ঠিক যেন গল্পের বইতে পড়া এক স্বপ্নের দুনিয়া। স্বপ্ন ভঙ্গ হল গাড়িতে বসার পর। গিরিরাজ সিংহের পরিবার সদর দরজা পর্যন্ত এসে আমাদের বিদায় জানিয়ে গেলেন। গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হতেই কোথায় যেন একটা ময়ূর ডেকে উঠল। মনে মনে ভাবলাম, আবার আসিব ফিরে..!

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com