নিখাদ প্রেমের এই পালা বলা যায় শরৎচন্দ্রের দেবদাসকে হারিয়ে দিয়েছিল। প্যান্ডেল থেকে চোখ মুছতে মুছতে বের হতেন না এমন নারী-পুরুষের সংখ্যা পাওয়া ছিল দুষ্কর।
প্রতিবছর যেমন হালখাতা হয়, তখনও যাত্রাপালায় হালখাতা হতো। বায়না দেওয়া হত, উল্টোরথে বুকিং নেওয়া হতো ঠিকই, তবে পছন্দমতো তারিখ পাওয়া যেত না। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকটাতেও বেশ জনপ্রিয় ছিল যাত্রাপালা। তার বেশ কিছুদিনের মধ্যেই হঠাৎ ভাটার টান। যাত্রার স্বর্ণযুগ বলা হয় সত্তরের শুরু থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়টাকে। অনেকে বলেন, ততদিনে গ্রামে ঢুকে পড়েছে টেলিভিশন, বিনোদন ঘরের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ায় যাত্রার নাকি কদর কমেছিল।
কিন্তু যারা যাত্রাপালার আয়োজন করত তাদের মতে ভালো মানের শিল্পীরা এ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন বলেই আজ এ অবস্থা। বর্তমানে যে যাত্রাপালা এসেছে তা মানুষের মন জয় করতে পারেনি। তাই যাত্রাশিল্পে ভাটা পড়তে শুরু করল।
আশির দশকে নামকরা পালা দেখতে যেমন মানুষ ছুটতেন প্যান্ডেলে। গ্রামে হতো মনসার ভাসান, বনবিবি চম্পা, রূপবান যাত্রা, বেহুলা-লখিন্দর, লায়লা মজনুর মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় যাত্রাপালা। গ্রামে খেটে খাওয়া মানুষ হিন্দু-মুসলমান সন্ধের পর একসঙ্গে বসতেন রিহার্সালে। এক-একটা দল দু তিনটে করে পালা নামাত। সেরা অভিনেতা অভিনেত্রীকে খুশি হয়ে বহু মানুষ পুরস্কার দিতেন, তাদের নাম ঘোষণা করা হতো মাইকে, এই নাম ঘোষণার ব্যাপারটা নামী যাত্রাতেও হতো, গ্রামের মানুষ মনে করতেন এতে তার সম্মান বেড়েছে, দেখাদেখি আরো অনেকেই ছুটে আসতেন স্টেজে। অভিনেতাদের মোটা টাকা ব্যক্তিগত আয় হতো। গ্রামে একসময় যাত্রাপালার প্রতিযোগিতা হতো।
সেসব দিন এখন আর নেই। এর কারণ কী? এখন মানুষের সময় কম। সবাই ছুটছেন আয়ের জন্য। সন্ধেবেলাতেও ফুরসত নেই। ধর্ম বেশ বড় আকারেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, বাঙালি মুসলমানদের বাড়ির বউ আর আগের মতো যাত্রা দেখার অনুমতি পান না। হিন্দু মন্দির যেমন বাড়ছে, মুসলমানদের মসজিদও বাড়ছে। শহরতলি ছাড়িয়ে এই প্রবণতা এখন গ্রামেও। আগে দেখা যেত বেহুলা সাজছেন মুসলমান অবিবাহিত মেয়ে, হিন্দুর অবিবাহিত ছেলে সাজছেন লখিন্দর, সেসব দিন আর নেই। ধর্মের বেড়াজাল হয়ত আটকে দিয়েছে অনেক কিছু। পাশাপাশি যাত্রাপালায় অসাধু মানুষের নজর পড়েছে। এসেছে অশ্লীলতাও। এছাড়া ঘরে ঘরে এখন টেলিভিশন আছে। হাতে হাতে মোবাইল-ল্যাপটপ আছে। যাত্রাপালায় সময় দেওয়ার সময়ের কই?
ডেইলি বাংলাদেশ