শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৪৩ অপরাহ্ন
Uncategorized

মুসলিম মডেলরা যাতে কথা বলতে পারে সে জন্য আমি আমার কেরিয়ার উৎসর্গ করেছি

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১

হালিমা আদেন হচ্ছেন প্রথম হিজাবী সুপারমডেল, এবং গত বছর তিনি ক্যাটওয়াকে হাঁটা ছেড়ে দেন – এই আশায় যেন অন্য মুসলিম নারীদেরকে তাদের ধর্মবিশ্বাস আর কাজের মধ্যে কোন একটিকে বেছে নেবার মত কঠিন কাজটি না করতে হয়।

“আমি চাই মেয়েরা জানুক যে হালিমা তাদের সবার জন্য একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল” – বলেন তিনি।

“আমি আমার কেরিয়ার ত্যাগ করেছি – যাতে তারা যে কোন জায়গায় কথা বলতে জড়তা বোধ না করে।”

এখন ফ্যাশন জগতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পথ খুঁজছে – যাতে হালিমাকে যে চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল তা যেন অন্য মুসলিম মডেলদের ক্ষেত্রে না হয়।

টমি হিলফিগার এর আগে হালিমাকে নিয়ে বহু ফ্যাশন প্রচারাভিযানে একসাথে কাজ করেছেন। সম্প্রতি বিবিসি তাদের একটি সাক্ষাৎকার নেয়। তাতে তারা এই শিল্পে বর্ণবাদ ও বৈষম্য মোকাবিলার নানা দিক নিয়ে কথা বলেন।

আমার হিজাব ছোট হয়ে আসছিল

“আমি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিলাম যেখানে আমি নিজেকে যেভাবে দেখি তার থেকে অনেক দুরে সরে যাচ্ছিলাম। আমার হিজাব ক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল”- বলছিলেন আদেন।

হালিমা এডেন ও টমি হিলফিগার
ছবির ক্যাপশান,হালিমা আদেন ও টমি হিলফিগার

হালিমা বলছিলেন, “একবার আমি একটা শুটিং করছিলাম সেখানে আরেকটি মুসলিম মেয়ে ছিল যে হিজাব পরতো। ওরা আমাকে আমার পোশাক পরিবর্তনের জন্য আলাদা একটা কুঠরি দিল, কিন্তু ওই মেয়েটিকে বললো, একটা বাথরুমে গিয়ে পোশাক বদলাতে। তো যখন আমি দেখলাম যে আমাদের প্রতি সমান আচরণ করা হচ্ছে না – সেটা আমার একেবারেই ভালো লাগেনি।”

আরেকদিন তাকে পোশাক বদলাবার জন্য এমন একটা জায়গা দেয়া হলো যেখানে যেতে হলে পুরুষদের পোশাক পরিবর্তনের জায়গাটার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

“এতে আমি খুবই অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম,” বলছিলেন হালিমা।

“এটা শুনলে আমি খুব বিপন্ন বোধ করি যে কিছু লোক বা স্টাইলিস্ট আছে – তারা আপনি যা বা আপনি যেভোবে চলেন – তা পাল্টে দিতে চায়” – হালিমাকে বলছিলেন টমি হিলফিগার।

টমি হিলফিগার অনেক দিন ধরেই ফ্যাশন শিল্পে আরো বেশি বহুত্ববাদ এবং অন্যদের জায়গা করে দেবার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।

হালিমা আদেন

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
হালিমা আদেন

ফ্যাশন জগতে বহু সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে টমি হিলফিগার ২০২০ সালে দেড় কোটি ডলার দেবার অঙ্গীকার করেছিলেন। প্যারিস ফ্যাশন উইকের সময় তিনিই হালিমাকে প্রথম ক্যাটওয়াকে তোলেন।

স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড ম্যাগাজিনে হালিমা আদেনই প্রথম মডেল হিসেবে বুরকিনি পরেছিলেন। শুধুমাত্র তার জন্য এই সুইমস্যুট বানিয়েছিলেন টমি হিলফিজার।

“আমার মনে আছে তোমার জন্য আমরা একটা বিশেষ সাঁতারের পোশাক বানিয়েছিলাম” – বলছিলেন টমি।

“বুরকিনি পরাটা ছিল এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা” – বলেন হালিমা।

“ফ্রান্সের মত কিছু দেশে পাবলিক সুইমিংপুলে এবং সমুদ্রসৈকতে এই বুরকিনি নিষিদ্ধ করা হয়। কাজেই স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের ওই সুইমস্যুট প্রকাশের মধ্যে দিয়ে আমরা নিশ্চিতভাবেই একটা বার্তা দিয়েছিলাম, একটা নাড়া দিতে পেরেছিলাম।”

তবে এই সীমাবদ্ধতা ভাঙা এবং বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার এই যাত্রাপথ মোটেও সহজ সরল ছিল না।

‘লোকে অসন্তুষ্ট হয়েছে’

“আমার মনে হতো আমি যেন একটা খুব সরু দড়ির ওপর হাঁটছি, এবং কখনো কখনো মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকরাও আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে” – বলছিলেন হালিমা।

নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইক ২০১৬ তে আনিসা হাসিবুয়ানের ডিজাইনের পোশাক কালেকশন।

ছবির উৎস,ANNIESA HASIBUAN/INSTAGRAM

ছবির ক্যাপশান,
মডার্ন মুসলিম নারীদের লক্ষ্য করেই পোশাকের ডিজাইন।

“আমি বহু মন্তব্য শুনেছি যেগুলো ছিল এই রকম – ‘বুরকিনি পোশাকটায় শরীরের গঠন খুব বেশি ফুটে ওঠে’। তবে অনেক অল্পবয়েসী মেয়ে সবসময় আমাকে মেসেজ পাঠাতো “আমরা তোমাকে ব্যতিক্রমী চেহারায় দেখতে চাই। আমরা তোমার স্কার্ফ ভিন্নভাবে পরা দেখতে চাই।”

“এটা ছিল খুব সরু একটা দড়ির ওপর হাঁটার মতো।”

বিবিসি এমন কয়েকজন মডেলের সাথে কথা বলেছে যারা ভিন্ন ধরনের সামাজিক পটভূমি থেকে আসা, এবং তারা ফ্যাশন জগত সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতাটা টমি ও হালিমার সাথে শেয়ার করতে চায়।

রামলা অসোবলে একজন মুসলিম মডেল – যার বয়স ২২। তিনি বলছেন, তিনি যাদের সাথে কাজ করেছেন তাদের কেউ কেউ এটা বুঝতে চাইতো না যে কিছু পোশাক আছে যা রামলার ধর্মবিশ্বাসে অনুমোদিত নয়।

“একজন স্টাইলিস্ট আমাকে প্রশ্ন করেছিল যে আমি একটা আঁটোসাঁটো পোশাক পরবো কিনা। তখন আমাদের মধ্যে এক বিরাট বিতর্ক হলো। কারণ আমি তাদের বললাম যে আমি এতটা শরীর-দেখানো পোশাক পরতে ইচ্ছুক নই,” বলছিলেন রামলা।

আরেকবার আমাকে একজন ফটোগ্রাফার প্রশ্ন করেছিল যে আমি পার্কের মাঝখানে কাপড় বদলাতে রাজি কিনা। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।”

হালিমা আদেন

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
হালিমা আদেন

হালিমা আদেন হচ্ছেন এমন একজন যার মাথায় স্টাইলিস্টরা জিন্স ও অন্য নানা রকম কাপড় পরিয়েছেন – তাই তার কাছে এ ব্যাপারটা নতুন ঠেকেনি।

“আমার মন খারাপ হয় যখন দেখি যে স্টাইলিস্ট এ ব্যাপারটা বোঝে না যে – তার সামনে একজন হিজাব-পরা মডেল দাড়িয়ে আছে এবং সে খুব আঁটোসাঁটো পোশাক পরে স্বস্তি বোধ করবে না।”

পরিবর্তনের সময় এসেছে

রামলার গল্প শুনে টমি হিলফিগারও মর্মাহত হলেন। তিনিও চান, হালিমা এবং রামলার মত মেয়েরা যে বৈষম্যের শিকার হয়েছে তার মোকাবিলা করতে।

“এ গল্প শুনে আমার সত্যি রাগ হচ্ছে, আমার মনে হয় এটা খুবই অসম্মানজনক” – বলছিলেন তিনি, “এমন একটা ব্যবসা বা সম্প্রদায়ের অংশ হওয়াটা খুবই লজ্জাজনক যাদের মধ্যে এরকম বস্তাপচা ধারণা কাজ করছে।”

“আমার আশা যে আমি সেই পরিবর্তনের একজন নেতা হতে পারবো। তা ছাড়া আমি বিশ্বাস করে যে এ পরিবর্তনটা ওপর থেকেই শুরু হবে।”

হালিমা আদেন

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
হালিমা আদেন

পৃথিবীর বড় বড় ফ্যাশন ব্র্যাণ্ডগুলো এখন অঙ্গীকার করেছে যে তারা তাদের কোম্পানির সকল স্তরে বহুত্ববাদ নিশ্চিত করবে।

তবে ২০১৯ সালে ম্যাককিনসে এ্যান্ড কোম্পানির “কর্মক্ষেত্রে নারী” শীর্ষক এক জরিপের উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে যে ফ্যাশন জগতের কোম্পানিগুলোর বোর্ড অব ডাইরেক্টরদের প্রতি চার জনের তিনজনই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ।

কেইলিন স্ট্যামার্স হচ্ছেন ২৩-বছর বয়স্ক একজন কৃষ্ণাঙ্গ মডেল। তিনি জানতে চান, সবক্ষেত্রে সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে টমি কী করছেন।

“যে সব কাস্টিং ডাইরেক্টর বা স্টাইলিস্টরা আমাদের হয়ে কাজ করেছে তার যখন আমাকে বলেছে যে অমুক মেয়েটি কিছু কারণে এ কাজের উপযুক্ত নয় – তাদের সাথে আমি অনেক লড়াই করেছি” – বলছিলেন টমি।

“আমি তাদের বলেছি – দেখ, দরজার ওপর আমার নাম লেখা আছে। তুমি আমার জন্য কাজ করো, আর আমরা তাই করছি – যা আমি করতে চাই।”

এ বছর ফ্যাশন শো-গুলোতে অনেক বহুত্ববাদী বৈচিত্র্য দেখা গেছে। মডেলদের মধ্যে ৪৩ শতাংশই ছিল অ-শ্বেতাঙ্গ।

আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনগুলোর প্রচ্ছদে ২০২০ সালে অর্ধেকের সামান কম মডেল ছিল অ-শ্বেতাঙ্গ। তার আগের বছরের তুলনায় এ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ১২ শতাংশ।

তবে পর্দার পেছনে কিন্তু এ বৃদ্ধির প্রতিফলন দেখা যায়নি। যুক্তরাজ্যে প্রতি ১০টি ফ্যাশন ডিজাইনের চাকরির মধ্যে একটিরও কম চাকরি পাচ্ছে অ-শ্বেতাঙ্গরা ।

টমি বলছেন, তার ব্র্যান্ডে ক্যাটওয়াকের সামনে ও পেছনে সব ক্ষেত্রেই বিভিন্ন বর্ণের মানুষেরা আছেন, সবাইকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে।

র‍্যাম্পে হিজাব পড়ে হাটছেন মডেলরা

ছবির উৎস,বিবিসি

ছবির ক্যাপশান,
র‍্যাম্পে হিজাব পড়ে হাটছেন মডেলরা

“আমি চাই এমন কেউ হিসেবে পরিচিত হতে যে কাজ করেছে, শুধু কথা বলেনি। আমি জানি যে আমি এক এ পরিবর্তন আনতে পারবো না। আমি আশা করি যেন পুরো ফ্যাশন শিল্পটাতেই একটা পরিবর্তন আসে। এটা যেন শুধু একটা বিজ্ঞাপন না হয়, বরং এটা পুরো কোম্পানির মধ্যে দিয়ে একটা নদীর মত প্রবাহিত হতে হবে।”

আমরা একে অপরের জন্য কিছু করতে চাই

হালিমা আদেন গর্বিত যে তিনি শালীন ফ্যাশনকে বৈশ্বিক দর্শকের সামনে নিয়ে এসেছেন, এবং এমন একজন রোল-মডেল হয়ে ঠতে পেরেছেন যাকে হিজাব-পরা মেয়েরা আদর্শ হিসেবে মানতে পারে।

“আমি যখন মডেলিং-এ গেলাম, তখন ব্যাপারটা এমন ছিল যে আমি আমার কমিউনিটির অনেক মেয়ের জন্য দরজা খুলে দিয়েছি। আমি আগে কখনো একটা ম্যাগাজিন খুলে হিজার পরা কাউকে দেখিনি যার সাথে আমি আত্মীয়তাবোধ করতে পারি।”

তবে হালিমা দ্রুত খ্যাতির শিখরে উঠলেও, ধীরে ধীরে তার মনে হয়েছে যে এ শিল্প তার মুসলিম ধর্মের সাথে খাপ খাচ্ছে না।

তিনি এখন চান, অন্য আরো ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটাতে।

“আমি এখন অন্য শিল্পের দিকে, অন্য ক্ষেত্রের দিকে তাকাচ্ছি – যেগুলোতে মুসলিম নারীদের জোরালো অবস্থান নেই। আমি চেষ্টা করছি কীভাবে সেখানেও এ ব্যাপারটা ভাঙআ যায়, আমি কিভাবে প্রথমবারের মত কিছু করতে পারি। আমি এখন শরণার্থী সংকটের ওপর শিশুদের জন্য একটি বই লিখছি।”

হালিমা ফ্যাশন শিল্পে জাতিগত বৈচিত্র্য নিয়ে আরো সংলাপ চান, যেখানে মডেলরা অংশ নেবেন, এবং সবাই একসাথে এজন্য কাজ করবেন।

“সবার ওপরে আমি চাই এখানে যেন সবাই সুযোগ পায়, একে অপরের জন্য ঐকান্তিকভাবে কাজ করে। আমার মনে হয় ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ খুবই আশাব্যঞ্জক।”

বিবিসি বাংলা

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com