শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:০৬ অপরাহ্ন
Uncategorized

বসন্তে শিকাগো

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৭ মে, ২০২২

শিকাগোর লিটল ইটালি থেকে হেঁটে ওয়েস্টার্ন ফরেস্ট পার্ক ট্রেন স্টেশন যেতে লাগে মিনিটদশেক। ব্লু লাইন ট্রেনে উঠে পড়ি। জ্যাকসন স্টেশনে নেমে হাঁটা লাগাই ডাউনটাউন শিকাগোর দিকে। তাপমাত্রা বসন্তেও ছ’ডিগ্রি সেলসিয়াস।  তবু বসন্ত এসে গেছে। বরফ গলে গিয়ে গাছগাছালির সবুজ শাখা দেখা গেলেই এখানে বসন্ত আসে। বরফের চাদর সরিয়ে পথঘাট জেগে ওঠে। গুল্মের ঝোপঝাড়গুলো প্রাণ ফিরে পায়। টিউলিপের বাল্ব থেকে স্টক মুখ তুলে জানান দেয়, আমিও আছি। কত রং সেই টিউলিপের। সঙ্গে গলা মেলায় আরও মরসুমি ফুলেরা। সত্যিকারের রঙের মেলা। রাস্তা পেরোতেই চোখে পড়ে বড় করে লেখা, ‘স্বামী বিবেকানন্দ ওয়ে’। সেই পথ ধরে গিয়েই রাজকীয় আর্ট ইনস্টিট্যুট অফ শিকাগো। টিকিট কাটাই ছিল আমাদের। গিয়ে দাঁড়ালাম মিউজ়িয়ামের ফুলারটন হলের ফয়্যারে, স্বামীজির প্রতিকৃতির সামনে। ক্যাপশন, ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা, সেপ্টেম্বর ১১, ১৮৮৩’। নীচে স্বামীজির স্বাক্ষর । এক বিরল অনুভূতির স্বীকার হলাম। ছবি নিলাম। সিকিউরিটিকে দিয়ে সেই হলের চাবি খুলিয়ে কাঠের সিঁড়িতে টুক করে একটা পেন্নাম ঠুকলাম। মঞ্চে উঠে ছবিও নিতে বাধা নেই এখানে।

এবার মিউজ়িয়াম ঘুরে দেখার পালা। সারা বিশ্বের সংগ্রহ সেখানে। ফোটোগ্রাফি থেকে মিনিয়েচার, পেপারওয়েট থেকে আর্কিটেকচার, ইসলামিক আর্ট থেকে টেক্সটাইল, ভারতীয় স্থাপত্য ভাস্কর্যের নমুনা, মহিষাসুরমর্দিনী থেকে গণেশ, টেরাকোটা, সেরামিক পটারি সব আছে। তারপর আর্ট গ্যালারিতে ইম্প্রেশনিস্ট পেন্টিং থেকে ডেকরেটিভ আর্ট, রেনেসাঁ আর্ট, মর্ডান আর্ট— সব দেখার পালা।

আর্ট ইনস্টিট্যুট থেকে গেলাম মিলেনিয়াম পার্কে। সেখানে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে ক্লিক ক্লিক!  চারিদিকে অনেক রঙিন অজানা ফুল। আইভিলতায় বেদানার মত রানিরঙের টুসটুসে কুঁড়ি। মধ্যে মধ্যে ফুলের ভারে নুয়ে পড়া স্বর্গীয় চেরি ব্লসমের রূপ। আর সেই গোলাপির সঙ্গে মেঘলা আকাশের ধুসর মিশে এক অদ্ভুত মায়াময় বিকেল। হাঁটতে হাঁটতে থকে যাওয়া সেই বিকেলে আরেক প্রাপ্তি স্ট্যান’স ডোনাট আর গরম কফিতে চুমুক।

কফিশপের বাইরে এসে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগে খোলা মুখে। বুঝি, নদীর কাছাকাছি এসেছি। শিকাগো নদীর তীরে গিয়ে উঠি। শহরের বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে ছোট্ট শিকাগো নদী। মিশিগান লেকে গিয়ে তার আত্মসমর্পণ।  জেড পাথরের মত সবুজ জলে ভাসছে স্টিমার। মাথার ওপর সিগ্যাল উড়ছে। সেতুর উপর চলমান শহর। পঁচিশে বোশেখের গোলাপি বিকেলে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে। রবিপ্রণাম সেরে এগিয়ে চলি লিটল ইটালির দিকে। সন্ধে নামে লিটল ইটালিতে। আমাদের সঙ্গে ঘরে ফিরছে বহু মানুষ। কেউ অফিসফেরত, কেউ স্কুলফেরত। প্রচুর এশিয়ান পড়ুয়া রয়েছে এখানে। আলো জ্বলে ওঠে খাবার দোকানগুলোয়। জীবন এখানে শুরু হয় সন্ধেবেলায়, সারাদিনের কাজের শেষে।

পরদিন অগডেন এন্ড টেলর বাসস্টপ থেকে রুজ়ভেল্ট এভিনিউ দিয়ে নামলাম গ্র্যান্ড পার্কের ধারে।  তুষারপাতের পর মাটিতে এখানে কাঠের কুচির মতো সার দেওয়া হয়। এই বিশেষ ম্যানিওরকে মাল্চ বলে। পার্কে মাল্‌চ ফেলে মিউনিসিপ্যালিটি। রেসিডেনশিয়াল এরিয়ায় বাড়িগুলোর সামনে মাল্‌চ ফেলার দায়িত্ব বাড়ির মালিকদের। বসন্তে যেন সুন্দর হয় শহর। ফুলে সেজে ওঠে বাগানগুলো!

গ্র্যান্ড পার্ক থেকে লেক মিশিগান দু’মিনিটের হাঁটাপথ। লেকশোর ড্রাইভ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চললাম। লেকের পান্না- সবুজ জলে সকালের রোদ্দুর তখন লুটোপুটি খাচ্ছে। শীতকালে বরফে জমে যায় এই লেক। পাশ দিয়ে জগিং ট্র্যাক। মাথার উপর সিগ্যালের সারি। সোনাগলা রোদ্দুর গায়ে মেখে ফিল্ড ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজ়িয়ামে দেশবিদেশের প্রাকৃতিক সংরক্ষণশালার দিকে চলি ।

তৃণভোজী আপাটোসরাসের পাশেই মাংসাশী, ভয়ংকর টিরেনোসরাস রেক্স’এর ফসিল যেন জীবন্ত।  সাউথ ডাকোটা থেকে নিয়ে আসা অতিকায় টিরেনোসরাসটির নাম সু (Sue) । ফিল্ড মিউজ়িয়ামের করিডোরে ছবি তুলতে বাধা নেই। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের পাশাপাশি সবুজের জয়গান। আর নানান দেশের গল্প শোনা ঘুরে ঘুরে।

হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের ধর্মীয় দেবী পেলে, আগুনের দেবী। তিনি পাথর গলিয়ে পাহাড় বানান, অরণ্য ধ্বংস করেন।   মাদাম পেলে এখনও এই অঞ্চলের আগ্নেয়গিরির লাভার স্রোত স্বয়ং নিয়ন্ত্রণ করেন, এমনই বিশ্বাস তাদের।


পলিনেশিয়ার আদিম আদিবাসী লাপিতা’দের (Lapita) সংস্কৃতি, তাদের বানানো পটারির নমুনা দেখা গেল। এবার  পাশেই শিকাগো মিউজ়িয়াম ক্যাম্পাসের জন.ডি শেড  মিউজ়িয়ামের দিকে পা বাড়াই। শেড মিউজ়িয়ামটি মূলত একোয়ারিয়াম। জলজ প্রাণীদের চিড়িয়াখানাই বটে! চিড়িয়া বলতে দু’একটা হাঁস, প্যাঁচা, পেঙ্গুইন আছে। তা ছাড়া দেশবিদেশের লক্ষাধিক মাছ আর সামুদ্রিক প্রাণীর সমাহার। জলের নীচে প্রবাল দ্বীপে ভাসমান জেলিফিস, সি এনিমোন, স্টারফিশ, সি হর্স, সি ড্রাগন, সি আরচিন— আরও কত কিছু! আমাদের নাকের ডগায় বিশাল বালুগা তিমি, ডলফিন ডাইভ দিচ্ছে জলের মধ্যে। চলতে চলতে হাজির হই এম্ফিথিয়েটারে। এক টুকরো জলাশয়ে ডলফিনদের তখন খেলা দেখানোর পালা। এরপর আসে সীল মাছ। থলথলে শরীর নিয়েও কত ওলটপালট , কত রঙ্গ তার ট্রেনারের আদেশমতো!  একজন বিজ্ঞ পেঁচা হাজির হল। এক নিমেষে উড়ে ভিতরে চলেও গেল! ছোটদের কলরোলে ফেটে পড়ল থিয়েটার হল। সঙ্গে আমরাও!

এবার গেলাম চতুর্মাত্রিক অর্থাৎ ফোরডি থিয়েটারে, বিশেষ চশমা পরে। সেখানে হরেক রকমের হাঙরের কেরামতি।  স্ক্রিনের সবকিছু থ্রিডি। চতুর্থ মাত্রার জন্য সিনেমায় স্পেশ্যাল এফেক্ট। কখনও জলের ফোঁটা এসে পড়ছে গায়ে। মনে হচ্ছে, পা ছুঁয়ে যাচ্ছে ঢেউ! স্ক্রিনে হাঙর তেড়ে এসে ল্যাজের ঝাপটা দিচ্ছে চোখের সামনে, চেয়ারগুলো কাঁপছে। আবার জলের বুদবুদ আছড়ে পড়ছে চোখে-মুখে। কখনও পাচ্ছি মাটির সোঁদা গন্ধ। দমকা হাওয়া এসে নাকেমুখে আছড়ে পড়ল হঠাৎ! মনে হচ্ছিল, জলের ধারে দাঁড়িয়েই হাঙরের খেলা দেখছি!

এখানে একবার সিটি পাস কিনে নিলে সব মিউজ়িয়ামে প্রবেশ করা যায়। পরদিন গেলাম সায়েন্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি মিউজ়িয়ামে। জ্যাকসন পার্কে গিয়ে প্রথমেই চললাম জাপানি গার্ডেন অফ ফিনিক্সের দিকে।  মেঘলা আকাশ আর ঠান্ডার কারণেই হয়তো চেরি ব্লসমে ভরে ওঠেনি বাগান। তবে যতটুকু পেলাম তা আমাদের চোখে অনেক!

মিউজ়িয়াম ঘুরে দেখতে দেখতেই মাদার্স ডে ট্রিটের প্ল্যান।  একদা শিকাগোয় আগত ইতালীয়রা আমেরিকার মতো করে নিজস্ব পিৎজা তৈরি করেছিল। এই ডিপ ডিশ পিত্জা হল ময়দার পাই ক্রাস্টে মাংস, সবজি আর পর্যাপ্ত চিজের পুর। উপরের টপিং সাধারণ পিত্জার মতো। দোকানের নাম জিওরডানোস।

রোজ সন্ধেয় ঘরে ফিরতাম বাসে কিংবা উবেরে। একবার টিকিট কেটে বাসে উঠলে দু’ঘন্টার মধ্যে সেই বাসে ফ্রি রাইড। গবেষণারত ছেলে-বৌ খবর রাখে সেসব সুযোগ সুবিধের। ঘরে ফেরার আগে মা’কে না জানিয়ে গ্রসারি স্টোর্সে ঢুকে পড়ে। বাড়ি এসেই হাতে তুলে দেয় এক বোতল রেড ওয়াইন।

-কেন খরচা করিস এত?

-মাদার্স ডে’র স্পেশ্যাল ডিল। খুব সস্তা।

শিকাগোর একটুকরো রান্নাঘরে মায়ের হাতের জাদুতে শুক্তুনি বড়ি দেওয়া পালংশাকের ঘন্ট থেকে লুচি! পরদিনের ব্রাঞ্চে কী হবে? শাকশুকা, বেলজিয়ান ডোনাটে পয়রা গুড় নাকি এগ মেয়োনিজ স্যান্ডউইচ? ব্রাঞ্চ সেরেই বেড়ানোর তোড়জোড় হবে কিনা!

সেদিন তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে টিউলিপ বিদায় নিতে নিতেই চেরি ব্লসম ফোটে, পাতায় ভরে যায় গাছ। দিনকয়েকের মধ্যেই সব ফুল ফোটা শেষ। তারপর তাদের ঝরে পড়ার পালা। ফুলের কুঁড়িগুলো পাকা চেরির মতোই টুসটুসে। তাই বুঝি অমন নাম এই গাছের! চেরি ফুলের উত্সব শেষ মানেই বসন্ত গিয়ে গ্রীষ্মের আগমন হল বলে।

মেপল পাতায় সবুজ রং দেখতে দেখতে ভাবি আমার দেশের খেজুর গাছের কথা। খেজুরের মতো মেপল গাছ থেকেও ভারী মিষ্টি রস মেলে। তিন ধরনের মেপল গাছ এখানে। তার মধ্যে হানি মেপল থেকে সিরাপ বার করে প্রোসেস করে খাওয়া হয়। বসন্তের শুরুতে ঠান্ডা থাকতে থাকতেই মেপল গাছের কান্ডে কাঠের দু’মুখ খোলা নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তার নীচে স্টিলের বাকেট ঝোলে। গরম ওয়াফলের উপর এই মেপল সিরাপ এখানকার পরিচিত ব্রেকফাস্ট । এবার দেখলাম ওক গাছের যে ব্যারেলে সিংগল মল্ট হুইস্কি প্রোসেসিং হয়, তার মধ্যে মেপল সিরাপ মজুত করে সিংগল মল্ট ফ্লেভার্ড মেপল সিরাপ বানানো হচ্ছে। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়! তা ছাড়াও বার্চ, এস্পেন আর ওকের ছড়াছড়ি চারিদিকে। হাজির হলাম উইলিস টাওয়ারে। আগে নাম ছিল সিয়ারস টাওয়ার। একশো তিনতলার স্কাইডেক পয়েন্টে গিয়ে শিকাগো দেখা আর ছবি তোলার পালা। এলিভেটরের গতিবেগ ১৮.২ মাইল প্রতি ঘন্টায় । আমেরিকা এবং ইউরোপের সর্বোচ্চ টাওয়ার এটি। একশো দশ তলা দীর্ঘ আকাশচুম্বী টাওয়ারে উঠেই ঝাঁ করে পৌঁছে যাওয়া উইলিস টাওয়ারের মাথায় । কাচের বাইরে উত্তরদিক জুড়ে লেক মিশিগান আর পশ্চিমে তখন রাত আটটায় সূর্যাস্ত হচ্ছে।

মিশিগান লেকের উপকূলেই শিকাগো। টাওয়ার আর স্কাইস্ক্রেপারের সারি, তার মধ্যে ব্যস্ত জনজীবন। স্কাইডেকের একশো তিন তলা থেকে সূর্যাস্তে চোখ রাখতে রাখতে আমাদের পালা এল । শূন্যে ঝুলে থাকা কাচের ঝুলবারান্দা থেকে পায়ের তলায় শহর দেখলাম। দাঁড়ানোর অনুমতি মাত্র এক মিনিটের। নীচে তাকালে ভয় করে, উপরে তাকালেও! অন্ধকার যত ঘন হতে থাকল তত‌ই শিকাগো আলো-ঝলমলিয়ে উঠল! মহানাগরিক আকাশরেখায় ফুটফুট করছে নক্ষত্রের মত আলোর রোশনাই।

ইতিহাস বলে, ১৮৭১’এ বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় এই শহর। গ্রেট শিকাগো ফায়ার নামে অভিহিত এই ঘটনায় পুড়ে ছারখার হয়েছিল ডাউনটাউন। আগুন লাগার কারণ কিন্তু খুবই তুচ্ছ। দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল একটি গরু! মিসেস অলিয়ারি নামে এক গোয়ালিনী তার শস্যখেতের কাছে দাঁড়িয়ে গরুর দুধ দুইতে ব্যস্ত ছিল। সেই গরুই নাকি লণ্ঠন উল্টে দেয়! আগুন লেগে যায় শস্যখেতে আর তা থেকে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ানক আগুন। সেই ভয়ের কথা মনে নিয়ে হেঁটে চলি পথ। হাজির হই অন্ধকার মাঠের মাঝে বিখ্যাত বাকিংহাম ফাউন্টেন দেখতে। এমনিতে শিকাগোর অলিগলি, কানাগলি মোটেই নিরাপদ নয়। যখন তখন গাড়ি থেকে নেমে বন্দুক দেখিয়ে ক্রেডিট কার্ড নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় পথচারীকে। তবে রাত ন’টাতেও এই অঞ্চল নাকি নিরাপদ। একসঙ্গে অনেক রঙের আলোর কারসাজি আর জলের খেলা দেখে সে রাতে ঘরে ফিরলাম।

পরদিন বিকেলে সূর্যাস্তের ঠিক আগেই হাজির হয়ে যাই শিকাগো নদীর ধারে। নৌকোবিহারে শহরের আর্কিটেকচার ট্যুর না নিলে নাকি জীবন বৃথা! সেই যে ভয়ানক আগুনে তছনছ হয়ে গিয়েছিল কাঠের বাড়িঘর, তারপর নতুন রূপে কংক্রিটের স্থাপত্যে পুনর্জন্ম হয় শিকাগোর। পূর্বের শিকাগোর সর্বপ্রথম সর্বোচ্চ টাওয়ার ছিল মাত্র ১০তলার হোম ইনসিওরেন্স বিল্ডিং। আর এখনকার সর্বোচ্চ আকাশচুম্বী টাওয়ার হল ১১৩তলার উইলিজ টাওয়ার। নৌকোর গা ঘেঁষে আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইন্টারন্যাশানাল হোটেল টাওয়ার। শিকাগোর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাওয়ার এই ৪৫০ মিটার লম্বা এবং ৯২তলার হোটেল।

শিকাগোর নাম ‘উইন্ডি সিটি’। এখানকার রাজনীতিবিদদের গরমাগরম বাক্যস্ফুরণই এই নামের কারণ। কিন্তু অনেকে ভাবেন লেক মিশিগানের কনকনে উত্তাল হাওয়ার জন্যই এমন নাম। উঁচু ট্রাম্প টাওয়ারের প্রযুক্তিও বেঁকানো কাচের, হাওয়ায় যাতে আন্দোলিত না হয়। নদীর পেট চিরে অজস্র সেতুর নীচ দিয়ে আমরা একে একে পার হতে থাকি বড় বড় অফিস বিল্ডিংগুলো।  শিকাগোর অন্যতম সিগনেচার স্থাপত্য দুটি পাশাপাশি ৬০তলার টাওয়ার। ভুট্টার শীষের মতো টাওয়ার দুটোকে কর্ণ কব টাওয়ার বলে। এই দুটি হল শিকাগো মেরিনা সিটির প্রথম রেসিডেন্সিয়াল বাড়ি।

গাইড জানালেন, শিকাগোর আদিম এলগোনিকান রেড ইন্ডিয়ান ট্রাইবদের ভাষায়  Chigagou থেকে শিকাগো নামের উত্পত্তি। শব্দটির অর্থ হল পেঁয়াজের ক্ষেত। সে সময় প্রচুর পেঁয়াজ ফলত এখানে। তবে Chigagou থেকে  Shikaawa নামে যে শব্দটি লোকমুখে ছড়িয়েছিল, তার অর্থ হল পচা, দুর্গন্ধযুক্ত পেঁয়াজ। নদীর ধারে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ত্রিভুজাকৃতির। সব রিসাইক্লেবল ইকোফ্রেন্ডলি মেটিরিয়ালে নির্মিত। রিভার কটেজগুলি ঠিক যেন পালতোলা ডিঙি নৌকাকৃতির। বহু আগে নদীতে সব আবর্জনা ফেলা হত, তাই নদীমুখো বাড়ির কোনও জানলা থাকত না নদীর দিকে। নদী দূষিত হওয়ার কারণে তখন শিকাগোয় কলেরাও হত। তবে এইসব রোগকে বহুদিন আমেরিকাবাসী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে, জানালেন গাইড।

ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সাকির বানানো মন্টগোমারি বিল্ডিং এল। এরা ট্যুইন টাওয়ারও বানিয়েছিল। এবার নদীর পাড়ে সূর্যাস্তের মাহেন্দ্রক্ষণ! প্রতিটি কাচের বাড়ির জানলায় আলোর বিচ্ছুরণ। দূর থেকে দেখা গেল নেভি পিয়ারের বিশাল হুইল। শিকাগোর আরেকটি জনপ্রিয় ট্যুরিষ্ট স্পট। জুন মাসে এই নেভি পিয়ারে চলবে আতসবাজির খেলা। মাথার উপর ড্রোন, বুঝি নদীর ছবি তুলছে। এবার এল বিশাল পোষ্ট অফিস। নদীর বুক চিরে সমান্তরাল ভাবে ৩৮টি ব্রিজ আছে। এরা যদি এতগুলো সেতুর এত বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে, তবে আমরা পারি না কেন?

ফেরার পথে বিখ্যাত জিরাডেলির চকোলেট ব্যুটিকে ঢুকে পড়ে গলা ভিজিয়ে নিই চকোলেট স্যস ছড়ানো, চকোলেট কুচি দেওয়া আইসক্রিম স্মুদিতে। বাড়ি ফিরে আপডেট রাখি আমার লগবুকে। রান্নাঘরে দুই ছাত্রছাত্রী প্রস্তুতি নেয় ডিনারের। বানিয়ে ফেলে ওয়ান-পট পাস্তা। শিকাগোর এক টুকরো ডাইনিং টেবিল তখন সত্যি সত্যিই ইতালীয় সিজ়নিং-এর গন্ধে জমজমাট!

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com