শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৩২ অপরাহ্ন
Uncategorized

পাহাড়ি খাবার

  • আপডেট সময় রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১

সেই ছোট বেলা থেকেই খাবারের ব্যাপারে আমি কখনো আপোষ করিনি। বরাবরই মায়ের হাতের রান্না আমার খুব প্রিয়। তার রান্না করা সেই মজার খাবারের স্বাদ যেন মুখে লেগেই থাকতো।

ছোট্ট শহর খাগড়াছাড়ির কল্যানপুর এলাকায় বেড়ে ওঠা আমার। পড়াশোনার জন্য প্রিয় জায়গাটিকে ছেড়ে আমাকে দূরের ঢাকা শহরে চলে আসতে হয়। তখনও বুঝিনি আমি অনেক কিছুই পিছে ফেলে যাচ্ছি। গত তিনটি বছর “বৈসাবি উৎসব” পালন করতে পারিনি এই দূরে চলে যাওয়ার কারণেই- সে কথা ভাবলেই কান্নায় চোখ ভেসে যায় আমার…

‘ফুল বিজু’র আগের রাতে সব বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে ফুল কুড়ানো, পরদিন সকাল বেলায় বাসায় সাজানো- এরপর নদীর জ্বলে ভাসিয়ে দেয়া দিনগুলির কথা মনে পড়তেই যেন আমার যান্ত্রিক শহরের শুন্য ঘর চেয়ে বলে-তুমি একা…

বছরের একটি আনন্দময় উৎসব বিজুর ‘পাজন’ যেন মুখে লেগে থাকার মতন একখানা রসগোল্লা। ইচ্ছে করলে যা সারা বছরই বানানো যায়, তবে বিজুর পাজনের মতো হয়না কখনই। সত্যি বলতে আমার পছন্দের খাবারের তালিকা অনেক লম্বা-বলে শেষ করা যাবেনা।

আমরা বাংলাদেশের দক্ষিন-পূর্ব অঞ্চলের তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছাড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এ বসবাস করি- যা পার্বত্য চট্টগ্রাম এর আদিবাসী জনগোষ্ঠী বলে পরিচিত। আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো পাহাড়ে উৎপাদন হয় বলে পাহাড়ি খাবার নামেই পরিচিত।

আমরা জুম চাষ ও জুম ফলনের মাধ্যমে নিজেদের খাবার উৎপাদন করি। পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যায় আমরা চাকমারা, তারপর মারমা, ত্রিপুরারাই বেশি। আর কিছু সংখ্যক বম, মুরং, হাজং, খুগিসহ প্রায় ১২টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে।

বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু বা সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’তে থাকে সবার পছন্দের ‘পাজন’। ‘পাজন’ হরেক রকমের প্রায় ৩০/৪০ প্রকারের সবজি দিয়ে রান্না করা হয়। এছাড়া থাকে আদিবাসি পিঠা- যা বৈসাবি ছাড়াও সারা বছর ধরেই বানানো হয়। যেমন চাকমাদের বড়া পিঠা, সান্নি পিঠা, ব্যাং পিঠা, হাত্তল (কাঁঠাল) পিঠা, বিনি হগা, বিনি পিঠা। মারমাদের মারমা পিঠা, বাঁশের চুঙয় মারমা পিঠাসহ আরও অনেক ধরণের পিঠা- যেগুলোর বেশির ভাগই তেল ছাড়া বানানো হয়।

আমার মনে আছে, ছোট বেলায় মাকে বলতাম- ‘মা পাতিলায় রান্না করো দেখেছি, কিন্তু বাঁশে কীভাবে রান্না করো?’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আর বলতাম- ‘মা ক্ষুধা লেগেছে আর কতক্ষণ?’ মার কাছেই শোনা বাঁশের রান্নায় একটু সময় লাগে। আমি নিজের চোখেও দেখেছি- তাও বসে থাকতাম সেই বাঁশের চুঙওতে রান্না খাওয়ার জন্য। বাঁশের চুঙও দিয়ে মাছ, মাংস, সব্জি, ডিম সব-ই রান্না করা যায়। যা আমাদের (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা) সবারই খুব পছন্দের খাবার।

একটা সময় ছিল যখন কলা পাতায় খাবার খাওয়ানো হতো যেকোনো অনুষ্ঠানে। ছোট বেলায় দাদু বাড়ি গেলে কলা পাতায় ভাত খাওয়া ছিল অন্য রকমের আনন্দের। তাছাড়াও কলা পাতায় কী যেন একটা আছে তা “হেবাং” না খেলে বুঝার কোন উপায় নেই। হেবাং-এ কলা পাতা মুড়িয়ে তাতে মাংস অথবা মাছ কিংবা ডিমসহ আরও অনেক কিছু দিয়ে রান্না করা হয়। এই খাবারটি খুবই সুস্বাদু, পেট ভরে খাওয়ার যায়।

আমরা আদিবাসিরা কম বেশি সবাই একই রকমের খাবার খাই- যার বেশিরভাগই তেল ছাড়া রান্না করা হয়। কচি বাঁশের ‘বাঁশ কোরল’ বেশ মজার খাবার- এটি সিদ্ধ করে তেল বা করই দিয়ে রান্না করা যায়।

আর আমার প্রিয় আঙ্গুল চেটে খাওয়া খাবারের একটা নাম মুখে আসছে, চাকমা ভাষায় এর নাম ‘হুরবো’ এবং মারমা ভাষায় ‘লাক্সু’। আমাদের আদিবাসিদের কাছে এটি খুবই পছন্দের একটি খাবার। ত্রিপুরাদের পছন্দের খাবারের নাম ‘চাকরোয়’- যা তাদের অনেক পছন্দের।

যান্ত্রিক শহরে বার্গার, পিৎজা, শর্মা এইগুলোর চেয়ে এই খাবারগুলো আমার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু চাইলেও পরিস্থিতি, অবস্থা আর সময়ের অভাবে সবসময় খেতে পারিনা।

ঢাকায় অনেক রেস্তোরাঁয় আমাদের এই মজার খাবারগুলো পাওয়া গেলেও, ওখানকার স্বাদটা ঠিক পাওয়া যায়না।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com