কোস্তা ভর্দে। শব্দযুগল পর্তুগিজ, মানে কূলবর্তী সবুজ, এটা একটা রাস্তা, দুরন্ত সুন্দর রাস্তা। রিও ডি জেনিরো এবং সাও পাওলো, ব্রাজ়িলের এই দুই মেগাসিটিকে সংযুক্ত করেছে ৫৮০ কিমি ব্যাপী অতলান্তিকের পার ঘেঁষে ছুটে চলা এই পথ। সাও পাওলো পৌঁছনোর ঠিক আগে ছুঁয়ে গেছে স্যান্টোস শহরকে। হ্যাঁ, পেলের সেই বিখ্যাত শহর স্যান্টোস।
পথের একপ্রান্তে অতল জলের আহ্বান। কাকচক্ষু নীলের মাঝে তটভাঙা ঢেউয়ের শুভ্র স্বচ্ছ বিচ্ছুরণ। অন্যপ্রান্তে পাহাড় আর তার উপরে সবুজ, নিঃসীম, নিরন্তর আকাশ। অবুঝের মতো বাঁধভাঙা এই সবুজের বিস্তারের মধ্য দিয়েই আঁকিবুকি কেটে ছুটে চলেছে কোস্তা ভর্দে। যাবার পথে চুম্বন করে যায় প্রতিটি খাঁড়িকে, যেগুলোতে গড়ে উঠেছে পিকচার পোস্টকার্ডের মতো ছোট ছোট জনপদ। চোখ জুড়িয়ে যায়, হৃদয় স্নিগ্ধ হয়। এই পথের প্রায় মাঝখানে, ইতিহাসের হাত ধরে থমকে দাঁড়িয়ে আছে পারাচি। ব্রাজ়িলের ‘গোল্ডরাশ’-এর স্মৃতি বুকে ধরে।
হলিউডের কৃপায় ‘গোল্ডরাশ’ বললেই ক্যালিফোর্নিয়ার কথা মনে পড়ে। কিন্তু তারও প্রায় ১০০ বছর আগে প্রথম গোল্ডরাশ হয় ব্রাজ়িলের মিনাস প্রদেশে। পারাচি ছিল মিনাস যাবার ট্রানজিট পয়েন্ট এবং সোনা রপ্তানির বন্দর। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত পৃথিবীর অর্ধেক সোনা এখান থেকেই যেত। পর্তুগিজে পারাচি কথাটির মানে ছোট খাঁড়ি। আবার কেউ বললেন, পারাচি এক ধরনের ছোট মাছের নাম, যা আগে এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেত। ষোড়শ শতক থেকে পর্তুগিজ ভাগ্যাণ্বেষীরা এই দিকে নজর দেয় এবং বসবাস শুরু করে। আমরা চলেছি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল বাসে। শহর ছাড়িয়ে যাবার আরও আধঘণ্টা পর থেকে অতলান্তিকের দেখা পাওয়া গেল।
আমার এই বারের সফরের সঙ্গী অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক কিন্তু জাত ট্রাভেলার এক বন্ধু। পথের দৃশ্যাবলি বাঁ দিকে বেশি আকর্ষক খবর নিয়ে, পাশাপাশির বদলে বাসের বামদিকে পরপর দুটো উইন্ডো সিট নিয়েছে। আমার পাশে সহযাত্রী জুটলো এক গোমড়ামুখো ফরাসি পর্যটক। আমার তরুণ সাথীর জুটলো এক ব্রাজ়িলিয়ান সহযাত্রী। তন্বী, ফটফটে সুন্দরী। পিছন থেকে দুজনের অনর্গল বকমবকা ভেগে আসছিল। যাক গে, যার যেরকম কপাল। আমি সাইড চেয়ারটা টেনে সিটটাকে আরাম কেদারাতে পরিণত করে অনির্বচনীয় সব চলমান দৃশ্যের স্রোতে ভেসে গেলাম। অতলান্তিকের কোল ঘেঁষে পাহাড়ের বুক চিরে হু হু ছুটে চলেছে বাস। জনপদগুলো আমার ঠিক আগেই ইলেকট্রনিক স্পিড ব্যারিয়র। বাস নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে, আবার বৈদ্যুতিক বেড়া পার হলেই লয়বদল। সরাসরি একজন থেকে ঝাঁপতাল। ভাবছিলাম বলিউডের ব্যাপারীরা, যাঁরা স্বপ্ন ফিরি করে বেড়ান তারা এই সব পথের সন্ধান পেলে ভারতীদের চোখের ‘স্বাদ’ একটু বদলাত।
পারাচির বাসস্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে এক স্কোয়ার কিলোমিটার মতো ছোট্ট জায়গাটা পেরোলেই ঐতিহাসিক ক্ষেত্র। আর চমকের শুরু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। মধ্যযুগীয় পাথুরে রাস্তা। অটোমোবাইলের প্রবেশ নিষেধ। বাহন বলতে ঘোড়ার গাড়ি। অধিকাংশ পর্যটক পদব্রজে চলেছেন। বাড়িগুলো সব মধ্যযুগের ইউরোপীয় রীতির। প্রথমে মনে একটু সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। এ কোন হলিউডের আর্ট ডিরেক্টরের নির্দেশে তৈরি সেট নয়তো? আস্তে আস্তে ভ্রম ভাঙল, বুঝলাম সবই লাইভ, কোনও সেট নয়। একবিংশ শতকে জেগে থাকা এক ঝলক ষোড়শ শতাব্দী। জানলাম ব্রাজ়িলিয়ান সরকার ১৯৬৬ সাল থেকে পারাচিকে ন্যাশনাল মনুমেন্ট-এর মর্যাদা দিয়েছে আর সম্প্রতি নাকি ইউনেস্কো একে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’-এর অন্তর্গত করেছে।
পারাচিতে বেশ কিছু লেখক, শিল্পী এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেছেন। শোনা যায়, বুঝার জয়ী সাহিত্যিক সলমান রুশদিও এখানে বহুদিন অজ্ঞাতবাসে ছিলেন। রাস্তায় চলতে চলতে একটা বিশেষ ধরনের আর্ট এম্পোরিয়মের দিকে নজর আটকে গেল। পৃথিবীর নানা দেশের বিভিন্ন মুদার ওপর বিভিন্ন ধরনের সব অসামান্য শিল্প সৃষ্টি। শিল্পী উরুগুয়েন, তিন পুরুষের পেশা। এম্পোরিয়মের সামনেই রাস্তার একেবারে ওপরে নিবিষ্ট মনে কাজ করে চলেছেন। একটা ভারতীয় মুদ্রার ওপরে সুন্দর করে ‘ওঁ খোদিত দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপারটা কি? সবজান্তার স্টাইলে জানতে চাইলাম, এটা কি নিছকই একটা ড্রয়িং? শিল্পী নিজের কাজ ছেড়ে উঠে এলেন। প্রাঞ্জলভাবে ‘ওঁ -এর তাৎপর্য জানিয়ে প্রশ্ন করলেন, আমরা ভারতীয় কি না। ভাব জমে গেল। আমাদের কাছে বেশ কিছু ভারতীয় মুদ্রা ছিল। সেগুলো এঁকে দিয়ে দেওয়া। গেল।
ঐতিহাসিক ক্ষেত্র ছাড়াও পারাচি নৈসর্গিক দিক দিয়েও রীতিমতো ধনী, অতলান্তিক রেন ফরেস্ট, পাহাড়, ঝরনা, নীদ ও সমুদ্রের সঙ্গম, কি নেই এখানে? ছোট্ট শহরের মধ্যেই দুটো বিচ। পন্টাল’ এবং ‘জাবাকোয়ারা’। এছাড়া আশেপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে ৬৪টা দ্বীপ এবং প্রায় ১০০টা ছোট বড় বিচ। বেশ কিছু দ্বীপ ব্যক্তিগত মালিকানার অধীন। দ্বীপগুলোর ভেতরে ছবির মতো সুন্দর বাংলো, প্রাইভেট বিচ ও জেটি। জেটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিলাসবহুল ইয়ট। ‘পার্কে আসু’ নদীর মোহানা থেকে মোটরবোট ভাড়া নিয়ে এই সব দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। মোহানা ছাড়িয়ে মোটরবোট দুরন্ত গতিতে ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে ছুটে চলেছে অতলান্তিকের গভীরে। আর আমি ভাবছিলাম আমাদের নদীগুলোর পাড়ে পাড়ে কেন এমন স্বর্গ গড়ে ওঠে না? দূরের পাহাড়ের অনেক উঁচুতে “ডিফেন্সো পারপিচিও’ দুর্গের কামানগুলো সমুদ্রপথের দিকে নির্নিমেষে অকিয়ে। সকালে যে নীল অতলান্তিকের পাশ দিয়ে দিয়ে এসেছিলাম, সে এখন রং বদলে পান্না সবুজ।
জলপথের পরে আবার স্থলপথ। নিসর্গ আর মানুষ, দু’পক্ষেই পসরা সাজিয়ে তোলার প্রতিযোগিতা। তাই দেখার আর শেষ নেই। কিন্তু চলৎশক্তির তো একটা সীমা আছে। পদযুগল বিদ্রোহ ঘোষণা করবার আগেই তাই পন্টাল বিচের ওপরে বসে পড়লাম। ইতিমধ্যে আমার তরুণ সাথী এক অ্যাফ্রো-আমেরিকান সহযাত্রী জুটিয়ে পাহাড়ি পথে ট্রেকিং-এ বেরিয়ে পড়েছি। বলে গেল ওয়াটার ফলস দেখতে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে দুজনে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল। ওদিকে ওয়াটার তো দেখা গেল না, ব্যাপারটা শুধু ফলস এ না দাঁড়িয়ে যায়।
ধপধপে সাদা বিচের ওপরে সারি সারি লাল ছাতা। তার একটার তলে আমি একাই ছত্রপতি। আশপাশে বাকি সব ক’টার তলায় সব যুগলে দুলছে। অনতিদূরে কিয়স্ক থেকে ভেসে আসা টাটকা মাছভাজা আর ব্রাজ়িলিয়ান মদিরা ‘কাসাসা’র ঘ্রাণ চারপাশে একটা আবছা মাদকতার সৃষ্টি করেছে। আমার ঠিক সামনেই এক যুগল। তাঁদের টেবিলে অনেকক্ষণ ধরেই “কাসাসা’র গেলাস দুটো অচ্ছুৎ হয়ে পড়ে আছে। চুম্বন সম্পৃত্ত অধরগুলো গ্লাসের কাছে পৌঁছবার সুযোগই পাচ্ছে না।
আকাশ বেয়ে সূর্য আস্তে আস্তে পিছলে যাচ্ছে আঁসু নদীর গা ঘেষে অতলান্তিকের গর্ভে। দূরে কেলি সাঙ্গ করে জলকন্যাদের সব ঘরে ফেরার পালা। এক পাড়ে সুন্দর কংক্রিটের রাস্তা আর অন্য পাড়ে সারি সারি রেস্তরাঁ। দুই পাড়ের বুক চিরে সরলরেখায় বয়ে চলেছে ‘আঁসু’ নদী। গাঢ় হলুদ রঙের গোলাকার বস্তুটি সমুদ্র-গর্ভে ঢুকেযাবার সঙ্গে সঙ্গে টুপটাপ করে জ্বলে উঠল রেস্তরাঁর আলোগুলো। আলোছায়ার মায়ায় তখন নদী লাস্যময়ী। রাস্তার ওপরে কাঠের টেবিল ও চেয়ার ছড়ানো। টেবিলে টেবিলে বিখ্যাত ব্রাজ়িলীয়ান মদিরা ‘কাসাসা’ এবং ইতালিয়ান পাস্তা ও পিৎজা। কোনও কোনও রেস্তরাঁর ভিতরে বা দরজার সামনে গান বাজনার আসর বসে গেছে।
আমরা রাস্তার শেষপ্রান্তের রেস্তরাঁটি বেছে নিলাম। একটি পাঁচিল ঘেরা আয়তক্ষেত্র। গাছপালায় ভরা। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া গাছের মধ্যে রং- বেরঙের টুনি বাল্ব ঝকমক করছে আর তার তলায় তলায় টেবিল পাতা। এককোণে কাঁচে ঘেরা অংশে চুড়ান্ত তৎপরতা। হাতে গরম পিৎজা তৈরি হবার সঙ্গে সঙ্গে ওয়েটাররা টেবিলে টেবিলে তা নিমেষের মধ্যে পৌঁছে দিচ্ছে। আলো আঁধারির মধ্যে গ্লাসের আর কাটলারির টুংটাং আওয়াজ। তার চারপাশে পর্তুগিজ, স্প্যানিশ বা ফরাসিতে বার্তালাপ। আয়তক্ষেত্রের অপর কোণে এক সুবেশ ভদ্রলোক পিয়ানোতে নিচু পর্দায় ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালস-এর সুর ছড়িয়ে চলেছেন। নিবিষ্টচিত্তে ।
আমার সঙ্গীটি পিয়ানো খুবই ভাল বাজায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর হাত নিশপিশ করতে শুরু করল। বাজাবার খুবই ইচ্ছে, প্রতিবন্ধক শুধু সহজাত লজ্জা। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি পিয়ানোবাদক ভদ্রলোককে আমার ভাঙা পর্তুগিজ সম্বল করে জিজ্ঞাসা করলাম, যে আমরা কিছুক্ষণের জন্য পিয়ানোটির দখল পেতে পারি কি না। আমরা ভারতীয় গানের সুর বাজাতে চাই জেনে উনি সোৎসাহে আমার বন্ধুটিকে জায়গা ছেড়ে দিলেন।
পিয়ানো থেমে গেছে। চারদিকে তখন গুণগুণ কথা। মনে হচ্ছে বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় নারী ও পুরুষের সন্মিলিত কোরাস। মাঝে মাঝেই মদিরা বন্ধুটি দু’-একবার টুংটাং শব্দ করেই হঠাং যন্ত্রটির পূর্ণাঙ্গ দখল নিয়ে নিলেন। সমস্ত পরিবেশকে সচকিত করে নিটোল সুরে বেজে উঠল, চুরা লিয়া হ্যাঁয় তুমনে জো দিলকো…’। মুহূর্তের মধ্যে সব নিশ্চুপ। তারপরের মন্ত্রমুগ্ধ তিন-চার মিনিট। টেবিলে টেবিলে শুধু গানের সুরলহরী। বাজনা শেষ হওয়ার মুহূর্তেই বন্ধুটি আমাকে বিপদে ফেলে পিয়ানোর টুলটি ছেড়ে উধাও হল। তারপরে ভাষাবিভ্রাট সামলে আমার মতো এক অবাচীনকে কিভাবে একটাক বিদেশিকে এই মহান সঙ্গীতকারের পরিচয় বর্ণনা করতে হয়েছিল, সে এক সম্পূর্ণ অন্য গল্প।
কলকাতা থেকে ফ্লাইটে সরাসরি রিও ডি জেনিরো। ব্রাজ়িলের এই সুন্দরী শহরটিও আপনাকে মুগ্ধ করবে। রিও থেকে বাসে বা ট্যাক্সিতে পারাচি। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। ট্যাক্সি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অপরদিকে বিলাসবহুল বাসের সুব্যবস্থা রয়েছে। ভাড়াও ন্যায্য। রিও শহরের কেন্দ্রবিন্দু থেকে ২ কিলোমিটার মধ্যেই বিশাল বাস টার্মিনাল Rodoviaria Novo Rio Bus Station। বাসের অগ্রিম টিকিট কাটা ভাল। ওয়েবসাইট www.nosorio.com.br। বাসে চেপে সরাসরি পৌঁছে যাবেন পারাচির ‘Rua Jango Padua টার্মিনালে। শহর থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বের মধ্যে! ‘Costa Verde কোম্পানির বাস প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পাওয়া যায়।
যখন খুশি। সত্যি বলতে কি এখানে সবসময়ই আসা যায়। তবে ইস্টার-এর সময় এবং জুন জুলাই মাসে ভ্রমণার্থীর সংখ্যা বেশি থাকে। জুন মাসে মিউজিক এবং ডান্স ফেস্টিভাল, Theatre এবং Procession এর জন্য গোটা পারাচি মাতোয়ারা হয়ে থাকে। ইস্টার-এর সময়ে এখানকার টর্চলাইট প্রসেশন বিখ্যাত।
থাকবার জায়গা এখানে অজস্র। বাজেট থেকে সুপার লাক্সারি পর্যন্ত। পর্তুগিজ ভাষায় সরাইখানাকে বলে পৌসাদা। পারাচি এরকম অজস্র পৌসাদার ছেয়ে আছে।
ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন এরকম মানুষ ব্রাজ়িলেই বেশ কম আর পারাচিতে প্রায় বিরল। তাই অর্থ পর্তুগিজ বা স্প্যানিশ ভাষা জানা থাকলে ভাল হয়। ব্রাজ়িলীয় মুদ্রা কলকাতাতে পাওয়া মুশকিল। তাই রিও শহর পৌঁছেই মুদ্রা বদলে নেওয়া দরকার।