শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০২ অপরাহ্ন
Uncategorized

নেহারি খেতে নল্লি হাউজে

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

ভোজনরসিক নুর-এ-মজিদ ভাই নল্লি দিয়ে তৈরী করা খাবারের গল্প করছেন। তার আয়েশি ভঙ্গিতে করা বর্ণনা শুনেই জিভে পানি আসার উপক্রম। গল্পের একপর্যায়ে নল্লি হাউজের কথা শুনি। সময় করে একদিন বিকেলে চলে যাই নল্লি হাউজে। খিলগাঁও রেল ক্রসিং থেকে হাতের ডানদিকে কিছুটা হেঁটেই ‘নল্লি হাউজের’ দেখা পাই। সদ্য চালু হওয়া রেস্টুরেন্টটি আয়তনে খুব বেশি বড় না। তবে, এই রেস্টুরেন্টের বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে তৈরী হওয়া প্রতিটি খাবারই গরুর নলা দিয়ে রান্না করা হয়।

স্পেশাল নেহারি ছাড়াও এখানকার অন্যান্য জনপ্রিয় নেহারি আইটেমগুলো হচ্ছে রগ নেহারি, গোশত পায়া নেহারি, রগ মগজ নেহারি। এছাড়াও পাওয়া যায় চিকেন চাপ, মালাই চিকেন আর তাওয়া চিকেন। নলা দিয়ে তৈরী অপূর্ব স্বাদের খাবারের সাথে পরিচিত হতে চাইলে আপনিও যেতে পারেন ‘নল্লি হাউজে’। এখানকার স্পেশাল নেহারি পেয়ে যাবেন মাত্র ২৬০ টাকায়। বিরিয়ানি ভক্তদের জন্য আছে ‘স্পেশাল নল্লি বিরিয়ানি’। দাম মাত্র ৩০০টাকা। অবশ্য চারজনের জন্য নিতে চাইলে ১১০০ টাকায় কম্বো সুবিধাও রয়েছে।

ঝাঁঝালো স্বাদের এই নেহারিতে দেওয়া হয়েছে ঝোলা মাংস, রগ, গরুর মগজ

নল্লি হাউজে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে বেশ আশ্চর্যই হলাম। কারণ রেস্টুরেন্ট তখনও ফাঁকা! এখানকার কর্মী মো. রাব্বি জানালেন, নল্লি হাউজের শাটার মাত্রই তোলা হয়েছে। চেয়ারে বসে মেনুকার্ড দেখছিলাম। লোকমুখে জেনেছি এখানকার ‘স্পেশাল নল্লি নেহারি’ বেশ জনপ্রিয়। দ্রুতই অর্ডার করে দিলাম স্পেশাল নল্লি নেহারির সাথে স্পেশাল মালাই চিকেন। মুরগির মাংসের চাপ ছোট ছোট করে কেটে মশলা সহকারে বানানো হয় মালাই চিকেন। নেহারির সাথে খাওয়ার জন্য নিলাম রুমালী রুটি। এটি ময়দা দিয়ে তৈরী করা একপ্রকার বড় রুটি। গরুর নলার নেহারি তৈরীতে এমনিতেই সময় বেশি লাগে। কথা বলে জানা গেলো নল্লি হাউজ খোলা হয় বিকালের পরেই। বিকালেই রান্না শুরু হয়। বেচাকেনা চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর প্রায় ৫ ঘণ্টার মতো খোলা থাকে রেস্টুরেন্ট।

খেতে কেমন এই নল্লি নেহারি

আমরা জানি, নেহারি একটি ফার্সি শব্দ। এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় সকালবেলার নাশতা। দিল্লিতে নেহারি খাওয়া হতো সকালবেলা। কিন্তু নল্লি হাউজের স্পেশাল নল্লি নেহারি খেতে হলে আপনাকে সন্ধ্যার পরেই আসতে হবে। সন্ধ্যা বাড়তেই রেস্টুরেন্টে ক্রেতাদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। সকলেই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এদিকে আমার অর্ডার করা স্পেশাল নল্লি নেহারি টেবিলে উপস্থিত। নেহারিতে একখণ্ড গরুর নলা দেয়া হয়েছে। আকারে মাঝারিই বলা যায়। চামচে নেহারি নিয়ে মুখে দেয়ার সাথেই বুঝতে পারলাম এর বিশেষত্ব আসলে কোথায়। বেশ ঝাঁঝালো স্বাদের এই নেহারিতে ঝোলা মাংস, রগ, গরুর মগজ ইত্যাদি দেয়া হয়েছে। নেহারির উপরের ঝোলকে মোটেই পাতলা বলা যায় না। বিশেষ রেসিপি ব্যবহার করে এই তরল অংশটুকুকে ঘন করা হয়। রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের মতে, অন্যান্য রেস্টুরেন্টে পরিবেশন করা নেহারির সাথে এখানেই আমাদের বড় পার্থক্যটা বিদ্যমান। রুমালী রুটি দিয়ে অনন্য স্বাদের এই নল্লি নেহারি ও মালাই চিকেন খাওয়ার পরে আফসোস হচ্ছিল এতদিন খাইনি কেন!

নল্লি হাউজের মালিক জাওয়াদ হোসেনের সাথে কথা বলে বেশ আশ্চর্যই হলাম। জানা গেলো, ২০২০ সালের ১১ই ডিসেম্বর চালু হয় ‘নল্লি হাউজ’। রেস্টুরেন্টের এরকম নামকরনের পেছনের গল্পটাও দারুণ। তিনি বলেন, “আমি কখনোই চাইনি কোনো অপরিচিত নাম দিয়ে আমার কোনো প্রতিষ্ঠান চালু করি।”

ঢাকা নিবাসী তরুণ জাওয়াদ হোসেন ব্যবসার খুঁটিনাটি বেশ ভালোই জানেন মনে হচ্ছিল। তার মতে, ঢাকাবাসী নলাকে নল্লি নামেই ডেকে অভ্যস্ত। এরকম নামকরণের মাধ্যমে খাদ্যের সাথে স্থানীয়দের মনস্তাত্বিক একটা নৈকট্য স্থাপনের সুযোগ মেলে। এসব দিক বিবেচনা করেই এই নামকরণ। জাওয়াদ হোসেন এখানে ব্যবসা করছেন দীর্ঘদিন। নল্লি হাউজ নতুন হলেও পূর্বে এই স্থানে ‘কাবাবিজ’ নামক হোটেল ছিল তারই। ঐ হোটেলে কাবাব নিয়ে কারবার চলতো। এক বছর ব্যবসা করার পর কাবাবিজ হোটেল বন্ধ হয়ে যায়।

জাওয়াদ হোসেন এবং তার পিতা রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন প্রায় ৪০ বছর। ঢাকার পল্টনে অবস্থিত জাফরান ও রাঁধুনি নামক দুটি হোটেল দিয়ে তাদের এই ব্যবসা শুরু হয়েছিল। জাওয়াদ হোসেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন ২০১৯ সালে। তবে, তিনি রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নামেন ২০১৬ সাল থেকে। ‘দাওয়াত-ই-মেজবান’ হোটেল দিয়ে জাওয়াদ হোসেন তার ব্যবসা শুরু করেন। ধানমন্ডি, মতিঝিল এবং উত্তরাতে এটির শাখা আছে। জাওয়াদ হোসেন পৈতৃক ব্যবসাকে ধরে রাখার পাশাপাশি ব্যবসাকে বাড়িয়েছেন কলেবরেও। জানা যায়, মোট ১৮টি রেস্টুরেন্টের মালিক জাওয়াদ হোসেন।

এই রেস্টুরেন্টের মোট আসন সংখ্যা ৪০। সন্ধ্যার পর রেস্টুরেন্টের ভেতরে ও বাইরে ভিড় বাড়তে থাকে। নল্লি হাউজের বয়স দুই মাসেরও কম। কিন্তু, ভিড় দেখলে মনে হবে পুরাতন কোনো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। রাত ৮টার সময় হাউজের ৪ জন কর্মচারীর যেন দম ফেলার সময় নেই। এই পরিস্থিতির কারণ জানতে চাইলে জাওয়াদ হোসেন তার আরেকটি গোপন রহস্য ফাঁস করে দিলেন বেশ অকপটেই। তিনি বলেন, “আমার রেস্টুরেন্টের খাবারের চাহিদা লক্ষ্যণীয়। কিন্তু এই ব্যাপক চাহিদার মূলে আছে রান্নার ধরন। গরুর নলা দিয়ে খাবার তৈরি করা হয় অনেক হোটেলেই। তবে, আমরা আমাদের নিজস্ব রাঁধুনি দিয়ে পেশোয়ারের বিভিন্ন খাবারের সাথে ঢাকাই খাবারের একটা ফিউশন করেছি। নল্লি হাউজের জনপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম কারণ এটি।”

ভিড়ের প্রসঙ্গে জাওয়াদ হোসেন অর্থনীতির একটা সাধারণ সূত্রের কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বলেন, “কিছু দ্রব্যের যোগান কমলেও ক্ষেত্রবিশেষে তার চাহিদা বাড়ে। নল্লি হাউজের খাবারের ক্ষেত্রে একথা পুরোপুরি সত্য। আমরা রেস্টুরেন্ট চালু রাখি প্রায় ৫ ঘণ্টার মতো। তারপর দোকান বন্ধ করা হয়। ফলে অর্ধেক ক্রেতাদেরই ফেরত যেতে হয়। এতে করে ভিড় হওয়াটাই স্বাভাবিক। আবার, অধিক পরিমাণে গরুর নলা প্রাপ্তির বিষয়ও আছে। সবসময় পর্যাপ্ত গরুর নলা পাওয়া কঠিন। আমরা প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১৫০ পিস নলা সংগ্রহ করতে পারি। এদিক থেকে বলতে গেলে আমাদের পর্যাপ্ত যোগানের অভাব রয়েছে। ‘আগে গেলে আগে পাবেন’ নীতি অনুযায়ীই এখানে ভিড় হয়ে যায়।”

মিরপুর থেকে নল্লি হাউজে বন্ধুদের নিয়ে খেতে এসেছেন এহসানুল কবির অভি। এখানকার ‘রগ নেহারি’ খেতে খেতেই বললেন মিরপুর থেকে খিলগাঁওয়ে এসে খাওয়াটা তাদের কাছে ‘লস প্রজেক্ট’ মনে হচ্ছে না। তারা ইউটিউবে করা ভ্লগ-রিভিউ দেখে খেতে এসেছেন। তবে স্বাদ বেশ কড়া মনে হয়েছে তার কাছে। আরেক শিক্ষার্থী নাবিলা তাবাসসুম খাবার নিয়ে নল্লি হাউজের প্রশংসা করলেন। দাম এবং স্বাদের ক্ষেত্রে নল্লি হাউজকে অন্যান্য রেস্টুরেন্ট থেকে বেশ এগিয়েই রাখবেন তিনি।

নল্লি হাউজের এই প্রশংসার কথা জাওয়াদ হোসেনও জানেন। আলাপকালে জানালেন, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। নল্লি হাউজের শাখা করা হবে কিনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম। তার মতে, এ ধরণের খাবারের চাহিদা সাধারণত শীতকালেই বেশি থাকে। অন্য সময়ে বিশেষত, গ্রীষ্মকালে এই খাবারের চাহিদা থাকে না বললেই চলে। নল্লি হাউজ রেস্টুরেন্ট হিসাবে একেবারেই নতুন। আরো কিছুদিন ব্যবসা ধরে রাখাটাই একটা বিষয়। রেস্টুরেন্টের খাবারের মান সমুন্নত রাখাটাও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। অধিক চাহিদা তৈরী করতে অতিরিক্ত খাবার তৈরীর পক্ষপাতি নন তিনি। সব কিছু ঠিক থাকলে ঢাকার উত্তরা এবং পলাশীতে নল্লি হাউজের শাখা খোলার আশা ব্যক্ত করলেন জাওয়াদ হোসেন। এছাড়া, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানকে ঢাকাই খাবারের সাথে ফিউশন করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com