যাঁরা জার্মানি বেড়াতে যান, তাঁদের মধ্যে প্রায় কেউই সচরাচর ম্যাগডেবার্গে যাননি। সত্যি বলতে কী, বার্লিন থেকে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে দু’ঘণ্টার কিছু কম সময়ে যখন ম্যাগডেবার্গ হপ্টবানহফে (প্রধান ট্রেন স্টেশন) পৌঁছলাম, বুঝলাম জায়গাটায় বার্লিনের রোমাঞ্চকর ‘ভাইবস’-এর বড্ড অভাব!কিন্তু তিষ্ঠ! এত তাড়াতাড়ি শহরটাকে বোরিং তকমা দিয়ে ফেলবেন না। এ শহরের ইতিহাস বারোশো বছরেরও বেশি সময়ের! শিল্প, স্থাপত্য আর ইতিহাসে যদি আপনার আগ্রহ থাকে তবে ইউরোপীয় মধ্যযুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির মধ্যে অন্যতম ম্যাগডেবার্গআপনাকে হতাশ করবে না।দশম শতকে এখানেই থাকতেন রোমানসম্রাট প্রথম অটো (otto), যিনি পরিচিত ছিলেন অটো দ্য গ্রেট নামে। আবার সপ্তদশ শতকে এখানে থাকতেন রাজনীতিবিদ এবং বৈজ্ঞানিক অটো ভ্যান গুয়েরিকে, যিনি বহু বছর এই শহরের মেয়রছিলেন। তবে আজকেরম্যাগডেবার্গ প্রধানত এক ইউনিভার্সিটি টাউন, যার অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ওই মহান বিজ্ঞানীর নানেই, অটো ভ্যান গুয়েরিকে ইউনিভার্সিটি।
ম্যাগডেবার্গের সবচেয়ে বিখ্যাত দ্রষ্টব্য হলম্যাগডেবার্গক্যাথিড্রাল যা চোখে পড়ে শহরের প্রধান সড়ক Breiter Weg থেকে। ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে অটো দ্য গ্রেট একটি আশ্রম বানিয়ে উৎসর্গ করেন সেন্ট মরিসকে। গির্জাটি বানানো শুরু হয় ৯৫৫ সালে এবং তা ম্যাগডেবার্গের বিশপের ক্যাথিড্রাল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ৯৬৮ সালে। ৯৭৩-এ যখন রোমান সম্রাট মারা যান তখন ওঁকে এক পাথরের সক্রোফ্যাগাস (কফিন)-এ ওই ক্যাথিড্রালেই সমাধিস্থ করা হয়।১২০৭ সালে এই ক্যাথিড্রাল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন আর্চবিশপ আলব্রেশ্ট দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত নেন এক নতুন ‘আধুনিক’ ক্যাথিড্রাল বানানোর। কাজ শুরু হয় দু’ বছর পর আর চলে ১৩৬২ পর্যন্ত যখন ওই ‘আধুনিক’ গথিক ক্যাথিড্রাল দেবসেবায় উৎসর্গ করা হয়। ক্যাথিড্রালের দক্ষিণের পরিচিত দুই মিনারের কাজ (যার উচ্চতা ১০৪ মিটার), শেষ হয় ১৫২০ সালে।তখন জার্মান স্থাপত্যে গথিক প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্যাথিড্রালটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মিনারগুলো বেঁচে যায়। যুদ্ধের পর বাকি জায়গা মেরামত করে আবার তার দরজা খুলে দেওয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য।ম্যাগডেবার্গ ক্যাথিড্রালে কোনও প্রবেশমূল্য নেই। কিন্তু আপনি যদি গাইডেড ট্যুর বুক করেন তবে ৪৩৩টি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে পারবেন ঘণ্টাঘরে, যেখান থেকে শহর এবং এল্বে নদী দেখা যায়।
দ্য গ্রিন সিটাডেল অফ ম্যাগডেবার্গ শহরের দ্রষ্টব্যের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে। এ যেমন কংক্রিটের মরুভূমির মাঝে এক মরুদ্যান! বাণিজ্যিক এবং আবাসিক ব্যবহারের জন্য বানানো এই বাড়ি সহজেই চেনে যায় এর অস্বাভাবিক ধাঁচ এবং রঙের জন্য। Breiter Weg-এর উপর অবস্থিত এই বাড়ির রং গোলাপি, এটি গাছ-গাছালিতে ভরপুর। এর মধ্যে আছে ৫৫টি অ্যাপার্টমেন্ট, সর্বসাধারণের জন্য কয়েকটা চত্বর, অনেক দোকান, রেস্তরাঁ, কাফে আর একটা ছোট ৪২-ঘরের হোটেল। ম্যাগডেবার্গ ক্যাথিড্রালের ঘণ্টাঘর থেকে এই সিটাডেল সুন্দর দেখা যায়। আমি নিজে ম্যাগডেবার্গ গিয়েছিলাম সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জাদুঘর দেখতে। এটিও শহরের এক প্রধান দ্রষ্টব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবি ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ‘দ্য পেন্টার অন দ্য রোড টু টারাস্কোন’ (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হারিয়ে যাওয়া ছবি হল রাফায়েলের সেল্ফ পোর্ট্রেট)। সেই ভ্যান গঘের ছবিটির মালিক এই জাদুঘর। আমার বই এই ছবির হারিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে এবং সেই কারণে আমি মিউজ়িয়ামের কিউরেটরের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম।
সেই সূত্রেই ম্যাগডেবার্গে আগমন। এখানে অন্যান্য অনেক ছবি-ভাস্কর্য আছে যা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। পনেরো থেকে কুড়ির দশকের ছবি, সেরামিকের জিনিস, আসবাবও আছে।নিজের বইয়ের জন্য আমি অটো ভ্যান গুয়েরিকে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতেও বেশ কিছু সময় কাটাই। সবার জন্যই খোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজানো-গোছানো ক্যাম্পাস আর বিশাল লাইব্রেরি।
ট্রেন স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটাপথ ফ্রাউননব্রুনেন। স্থানীয় ভাস্কর হাইনরিচ আপেলের ১৯৮৬ সালে বানানো এই ফোয়ারা একটা দেখার মতো জিনিস! এক বিশাল ব্রোঞ্জের কড়াই আর তার মধ্যে ও আশেপাশে বাইশখানা বাস্তব এবং কাল্পনিক জন্তু-জানোয়ার, মানুষের মূর্তি। এই ফোয়ারার চারদিকে ঘুরে দেখলেও সবক’টা মূর্তি নাও চিনতে পারতে পারেন।
যে দ্রষ্টব্যগুলোর কথা লিখলাম ওগুলো ছাড়াও বেশ কয়েকটা মিউজ়িয়াম, নানাবিধ সুস্বাদু খাবারের রেস্তরাঁ, সাইক্লিং রুট আর চার্চ আছে এখানে।বার্লিনের সঙ্গে শহরের নাইটলাইফের কোনও তুলনা চলে না।কিন্তু এখানে যে রাত্রিযাপন একেবারেই নিস্তরঙ্গ, তা নয় কিন্তু! সন্ধেবেলায় সঙ্গীদের নিয়ে বা পিপল-ওয়াচ করার জন্য চলে যান কাফে সেন্ট্রাল। লাইবিগ লাউঞ্জ আরও হ্যাপেনিংজায়গা। কিন্তু একটা কথা বলে রাখা ভাল, পাবগুলো ছাড়া বাকি শহর কিন্তু ঘুমিয়ে পরে একটু তাড়াতাড়ি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাগডেবার্গ গুরুত্বপূর্ণ শহর। ১৫ই জানুয়ারি ১৯৪৫-এর রাতে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্স এখানে কার্পেট বম্বিং চালায়। ৩৭১টি যুদ্ধবিমানের ৩৯ মিনিট আক্রমণে ২,৫০০ মানুষ প্রাণ হারান। ৯০,০০০ গৃহহীন হয়ে পড়েন। শহরটি একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে কীভাবে ধীরে ধীরে পুনর্নির্মিত হয়েছে—এ শহরের ফিরে আসাও কিন্তু একটা দেখার মতো জিনিস। অতএব টুরিস্ট ট্রেল-এর বাইরে গিয়ে আপনার জার্মানি ট্রিপ এর রুটম্যাপে ম্যাগডেবার্গকে দু’দিনের জায়গা দিতেই পারেন।