উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বৃত্তির জন্য কোথায়, কীভাবে আবেদন করা যায়, এ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। তাঁদের জানাতে চাই, অষ্ট্রেলিয়ায় এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুযোগ আছে। এখানে একজন বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী যেমন ‘টিউশন ওয়েভার’ পান, তেমনি এ দেশে বসবাসের জন্যও বেশ ভালো অঙ্কের ‘লিভিং অ্যালাউন্স’ বা ভাতা পেয়ে থাকেন।
২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী এই অঙ্কটা বছরে নূন্যতম ২৭ হাজার ৮২ ডলার। অর্থাৎ প্রতি মাসে একজন শিক্ষার্থী প্রায় ২ হাজার ২৫০ ডলার পান নিজের খরচের জন্য বৃত্তির পরিমান অবশ্য মূল্যস্ফীতির ওপর প্রতিবছর কিছুটা বাড়ে। এই বৃত্তির নাম রিসার্চ ট্রেনিং প্রোগ্রাম বা আরটিপি স্কলারশিপ। এর চেয়ে বেশি ভাতা পাওয়া যায় এমন বৃত্তিও আছে, যেমন এনডেভর ও সায়েনসিয়া স্কলারশিপ।
কানাডা ও আমেরিকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লিভিং অ্যালাউন্স পাওয়ার জন্য গবেষক বা শিক্ষকের সহকারী (টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট) হিসেবে কাজ করতে হয়। অষ্ট্রেলিয়ায়ও এই নিয়ম আছে। গবেষক বা শিক্ষকদের সহকারী হিসেবে কাজ করে যা আয় হয়, তা-ও মোটামুটি মন্দ নয়। আরও একটি সুবিধা হলো, কানাডা বা আমেরিকায় যেখানে পিএইচডি শেষ করতে একজন শিক্ষার্থীর অনেক ক্ষেত্রেই পাঁচ-ছয় বছর লেগে যায়, অষ্ট্রেলিয়ায় লাগে সাড়ে ৩ থেকে ৪ বছর।
অষ্ট্রেলীয়দের ভাষা যেহেতু ইংরেজি, পিএইচডি শেষে পৃথিবীর যেকোনো দেশেই চাকরি পাওয়ার ভালো সুযোগ থাকে। অষ্ট্রেলিয়া অভিবাসীনির্ভর দেশ, এখানে পিএইচডি শেষে প্রত্যক শিক্ষার্থী চার বছরের ‘ওয়ার্ক ভিসা’ পান। যাদের বিষয়টি অষ্ট্রেলীয় সরকারের প্রায়োরিটি জব লিষ্ট’- এ আছে, তাঁরা সহজেই স্থায়ী ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন।
বৃত্তির আবেদন করার আগে
১. পড়ালেখায় ভালো ফল: বৃত্তির ক্ষেত্রে ফলাফলকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যার ফল যত ভালো, তাঁর সম্ভাবনা তত বেশি। তবে নূন্যতম সিজিপিএ- ৩.৫ (৪-এর মধ্যে হলে আপনি কিছুটা এগিয়ে থাকবেন। কারও সিজিপিএ যদি এর চেয়ে কম হয়, তাহলে এগিয়ে থাকার জন্য তাঁকে জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের দিকে জোর দিতে হবে।
২. গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশনা: বৃত্তি পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো ‘ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর’ আছে এমন জার্নালে মূল লেখক (ফার্স্ট অথর) হিসেবে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ (পাবলিকেশন) করা। যাঁর ‘পাবলিকেশন’ যত বেশি, তাঁর বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা তত জোরালো। পাবলিকেশনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হলো, এটা দিয়েই গবেষণার অভিজ্ঞতা যাচাই থাকা উচিত। সহ- লেখক হিসেবে কয়েকটি পাবলিকেশন থাকলে আরও ভালো হয়।
৩. কাজের অভিজ্ঞতা: এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার ব্যাপারটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন সফটওয়ার প্রকৌশলী বা বায়োইনফরম্যাটিকসের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সফটওয়ারের ওপর ভালো জ্ঞান থাকাটাই অভিজ্ঞতা। আর লাইফ সায়েন্সের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বেসিক ল্যাব টেকনিকগুলো যেমন ডিএনএ, আরএনএ, প্রোটিন এক্সট্রাকশন এবং কোয়ান্টিফিকেশন, পিসিআর, সেল কালচার- এসব বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি।
৪. আইইএলটিএস স্কোর: অষ্ট্রেলিয়ায় বৃত্তির জন্য আইএলটিএসে টোটাল ব্যান্ড স্কোর ৬.৫-সহ সব ব্রান্ডে ৬ থাকতে হবে। তাই স্বাতকোত্তর পরপরই আইএলিটিএস স্কোর করে নিতে পারলে ভালো। আইএলটিএস স্কোর হাতে পাওয়ার পর শিক্ষকদের ই-মেইল করলে তাঁরা বেশি আগ্রহী হন।
৫. বিকল্প উপায়: এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি নবীন দেশ এবং আমাদের দেশে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা অনেক সীমিত। তারপরও আমাদের বিশ^বিদ্যালয়গুলোয় এখন গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অনেকেই ভালো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করছেন। যাঁদের একাডেমিক রেজাল্ট ভালো, কিন্তু কোনো ভালো পাবলিকেশন নেই, তাঁরা বিকল্প উপায় হিসেবে সময় নষ্ট না করে সাউথ কোরিয়া বা মালয়েশিয়ায় একটি গবেষণা নির্ভর ¯œাতকোত্তর শুরু করে দিতে পারেন। এর ফলেই সহজেই কয়েকটি ‘ফার্ষ্ট অথর পাবলিকেশন’ করে ফেলতে পারবেন। পরে বৃত্তির জন্য অষ্ট্রেলিয়ায় আবেদন করা সহজ হবে।
বৃত্তির আবেদনের ধাপ:
১. বিশ^বিদ্যালয় নির্ধারন: প্রথম কাজ হলো, নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী বিশ^বিদ্যালয় নির্বাচন করা। আপনার ‘প্রোফাইল’ যদি ভালো হয়; যেমন ভালো একেডেমিক রেজাল্টের পাশাপাশি কয়েকটি খুব ভালো পাবলিকেশন, তাহলে চোখ বন্ধ করে অষ্ট্রেলিয়ার গ্রæপ ৮-এর বিশ^বিদ্যালয়গুলোয় আবেদন করতে পারেন। অষ্ট্রেলিয়ায় সেরা আটটি বিশ^বিদ্যালয় নিয়ে গঠন করা হয় গ্রæপ ৮। এই আটটি বিশ^বিদ্যালয় হলো ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডেলেড, অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন, ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি, ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস, মোনাশ ইউনিভার্সিটি এবংইউনিভার্সিটি অব ওয়েষ্টার্ন অষ্ট্রেলিয়া। আর প্রোফাইল যদি মোটামুটি হয় তাহলে এগুলোর পাশাপাশি অন্য ভালো বিশ^বিদ্যালয়গুলোয়ও আবেদন করতে পারেন। যেমন ম্যাকুয়ারি ইউনিভার্সিটি, কুইন্সল্যান্ডইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, ওলংগংইউনিভার্সিটি, গ্রিফিথইউনিভার্সিটি, পার্থ ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি।
২. উপদেষ্টা নির্বাচন: বিশ^বিদ্যালয় নির্বাচনের পর কাজ হলো এই বিশ^বিদ্যালয়গুলো থেকে এমন একজন শিক্ষক বা গবেষককে উপদেষ্টা হিসেবে খুঁজে বের করা, যিনি আপনার পিএইচডির তত্ত¡াবধান করবেন। বিষয় অনুযায়ী শিক্ষক খুঁজে বের করার পর তাঁকে ই-মেইল করুন। ই-মেইল করার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। অনেকে বেশ বড় ই-মেইল লিখে ফেলেন, যেটা ঠিক নয়। আর বিশেষনের পর বিশেষন দিয়ে ই-মেইল সাজালে শিক্ষকেরা বিরক্ত হন। ¯œাতক, ¯œাতকোত্তরের ফল, পাবলিকেশনের সংখ্যা, আইইএলটিএস স্কোর- এগুলোই বরং গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়গুলোই-মেইল বোল্ড করে দিতে পারলে ভালো। পাশাপাশি নিজের পরিচয় এবং আপনি যে বিশ^বিদ্যালয় পড়েছেন সেই বিশ^বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করে শিক্ষককে পিএইচডি অ্যাডভাইজার হওয়ার আবেদন জানাতে হবে। সঙ্গে যোগ করতে হবে আপনার সিভি। এতটুকু যথেষ্ট।
আরেকটি বিষয় হলো, উপদেষ্টা খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে অনেকেই শুধু বিভাগের নাম দিয়ে গুগলে সার্চ করেন। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, ফলে অনেকেই গবেষণার সঙ্গে ভালোভাবে যুক্ত হতে পারেন না। অনেকের গবেষণার জন্য আলাদা তহবিল থাকে না। বিজ্ঞানের বিষয়ে সবচেয়ে ভালো গবেষণা হয় ইনষ্টিটিউটগুলোতে। এই ইনষ্টিটিউটগুলো তৈরিই করা হয় গবেষণার জন্য। ইনষ্টিটিউটে গবেষণার তহবিল থাকে, ভালো পাবলিকেশনের সুযোগ থাকে। এতএব, বিশ^বিদ্যালয়ের অধীন ইনষ্টিটিউটগুলোর শিক্ষকও গবেষকদের ই-মেইল করলে সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৩. বৃত্তির জন্য আবেদন: শিক্ষক-উপদেষ্টাকে রাজি করতে পারলে, বিশ^বিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্দেশনা অনুযায়ী বৃত্তি এবং ভর্তির জন্য আবেদন করতে হবে। আবেদনের জন্য একটি সুন্দর সিভি এবং একটি ভালো রিসার্চ প্রপোজাল লাগবে। বৃত্তির আবেদনের জন্য রিসার্চ সিভি তৈরির একটি লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি। এটা সবার কাজে লাগবে (মড়ড়.মষ/ঘাাুপড)। আর ‘রিসার্চ প্রপোজাল’ লিখতে হবে উপদেষ্টার গবেষণার বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে।