অঝোর বৃষ্টির মধ্যেই ঢাকায় অবতরণ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাঠমান্ডু-ঢাকা ফ্লাইট বিজি-৩৭২। পার্কিং বে-তে থামার পরও ৩০ মিনিট চলে যায় দরজা খোলার নাম নেই। যাত্রীরা তখন ছটফট করছিলেন নামার জন্য।
কেউ কিছু বুঝতে পারছিলেন না দরজা বন্ধ করে রাখার কারণ। প্লেনের ভেতরে যাত্রীরা অনেকেই নামার জন্য ব্যাগ কাঁধে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। পরে জানা গেলো বৃষ্টির কারণে যাত্রী নামানো যাচ্ছে না। শার্টল বাসে যাত্রী তুলতে গেলে একদিকে মাথার উপর বৃষ্টি, তেমনি পার্কিং বে-তে শুকতলা ডুবিয়ে যাওয়া পানি জমেছে। প্রায় ৪০ মিনিট পরে বৃষ্টির তেজ কিছুটা কমে এলে দরজা খুলে যাত্রীদের শার্টল বাসে নেওয়া হয়।
দরজা খুলে গুডবাই বলতে যাওয়া কেবিন ক্রুকে একজন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, বৃষ্টির মধ্যে নামবো কি করে। বোডিং ব্রিজে নিলেন না কেনো। কেবিন ক্রু ঝটপট জবাব দিলেন বোডিং ব্রিজ ফাঁকা পাওয়া যায়নি। প্লেনটি উত্তর প্রান্তের সর্বশেষ বোর্ডিং ব্রিজের (১১ নম্বর) মাত্র গজ ত্রিশেক দূরে পার্কিং বে-তে দাঁড়ানো।
পাশের ১১ নম্বর বোর্ডিং ব্রিজ তখন ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। আবার শার্টল বাসে ফিরতে দেখা গেলে বোর্ডিং ব্রিজ ৯ এবং ৭ নম্বরও ফাঁকা। যাত্রীরা এই দেখে বেশ আক্ষেপ প্রকাশ করলেন, কয়টা টাকা বাঁচানোর জন্য বোর্ডিং ব্রিজ ব্যবহার না করা অপেশাদার আচরণ। অন্য সময় যা হোক, বৃষ্টির মধ্যে এভাবে যাত্রীদের দুর্ভোগে ফেলার কোন মানে হয় না। এভাবে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান খুব বেশি দূর এগুতে পারবে না। এখন প্রতিযোগিতার বাজার, সবার আগে সেবা নিশ্চিত করতে না পারলে শেষে পস্তাতে হবে। যাত্রীরা একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে তাদের ফেরাবে কে। এই ধরনের সেবা খাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সুনাম।
দুর্ভোগ কি শুধু বৃষ্টিতে ভেজানো! তা হলে হয়তো এক আশা থাকতো, বৃষ্টি না থাকলে দুর্ভোগ থাকছে না। দুর্ভোগের শুরু হয় ২০ অক্টোবর বোর্ডিং পাস নেওয়ার সময় থেকেই। দীর্ঘ লাইন টিকেট দেওয়া হচ্ছে মহা ধীরগতিতে। কোন কোন টিকেট ইস্যু ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় নিচ্ছিলেন। একজনের টিকেট ইস্যু করতে গিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা। দুইবার পিসি থেকে উঠে গিয়ে অন্য অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। টিকেট যখন দিতে যাবে তখন সিনিয়র অফিসার পেছন থেকে হাক ছাড়লেন, আমি না বললাম ৭ নম্বর সিট কেউ আনলক করবা না। এটি লক থাকবে।
ফয়েজ আহমেদ নামের এক যাত্রী স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভ্রমণ করছিলেন। কোলে এক বছর বয়সী শিশু আর মেয়েটির বয়স ৮ বছরের মতো হবে। তাদের ৩টি টিকেট দেওয়া হলো (৯এফ, ১৮ই এই ১৯ সি) ভিন্ন ভিন্ন তিনটি জায়গায়। অনেক অনুরোধ করেও বিফল হলেন ফয়েজ আহমেদ। প্লেনে উঠে মেয়েটি অন্য যাত্রীর সঙ্গে বসতে চাচ্ছিল না। মায়ের আদেশে মুখ গোমরা করে বসে পড়লেন।
স্বামী-স্ত্রী বসলেন প্লেনের দুই প্রান্তে (৯এফ এবং ১৯সি) ভিন্ন সিটে। শিশু সন্তানটি বাবার কোলে গেলে মায়ের জন্য কান্না করছিল, আবার মায়ের কোলে থাকলে বাবাকে না দেখে কান্না করতে থাকলেন। সোয়া ঘণ্টার ফ্লাইটের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে কান্না করে নাজেহাল অবস্থা। শুধু ফয়েজই নয়, আরও কয়েকটি পরিবার একই অভিযোগ করলেন। নোমান নামের এক যাত্রীর পরিবারের ৫ সদস্যকে ভিন্ন ভিন্ন রো-তে সিট দেওয়া হয়।
২৩ অক্টোবর ফিরতি ফ্লাইটে ফয়েজ আহমেদের পরিবার পাশাপাশি আসন পেলেন। শিশু সন্তানটিও এদিন আর টু শব্দটি করলেন না। ফয়েজ আহমেদ বললেন, দেখলেন আজকে ছেলেটি একবারের জন্যও কান্না করেনি। সেদিন চাইলে তারা আমাকে পাশাপাশি সিট দিতে পারতো। এভাবে একজনকে এক মাথায় অন্যজনকে আরেক মাথায় সিট দেওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।
কাঠমান্ডু ত্রিভূবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে বোর্ডিং পাস ইস্যুতে কিছুটা গতি দেখা গেলেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নয়। একজন যাত্রীর পা প্লাস্টারের দিকে ইঙ্গিত করে গজ গজ করতে থাকলেন বিমান বাংলাদেশের স্টেশন ম্যানেজার শেখ আব্দুল মান্নান। জোর গলায় অন্যদের সতর্ক করলেন, আমার অনুমতি ছাড়া কেউ যেনো হুইল চেয়ার ইস্যু না করেন। আমার অনুমতি নিয়ে তারপর হুইল চেয়ার ইস্যু করতে হবে।
বিমান বাংলাদেশের বহরে যুক্ত হওয়া আধুনিক ফ্লাইট বোয়িং ৭৮৭-৮ হংসবলাকা। প্রত্যেকটি আসনের পেছনে এলসিডি টিভি বিদ্যমান। যাতে প্রত্যেক যাত্রী ভ্রমণকালে মুভি, নাটক দেখে সময় কাটাতে পারেন। কিন্তু বিধিবাম হেডফোনের কোন ব্যবস্থা নেই। অন্যান্য এয়ারলাইন্স এই টাইপের প্লেনে হেডফোন সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু বিমানের কাছে কোন গুরুত্ব পায়নি বিষয়টি।
প্লেনে খাবার পরিবেশন করা হলো চিজ বার্গার, খোলা বিস্কুট ও একটি ম্যাংগোবার। চিজ বার্গারে হাত দেওয়া দায়, মনে হচ্ছিল ডিপ ফ্রিজ থেকে বের করে এনে পরিবেশন করা হয়েছে। খাবার পরিবেশনের প্লাস্টিকের ৩টি ট্রে একসঙ্গে ফেরত দিতে গেলে মহিলা কেবিন ক্রু দরাজ গলায় বললেন, একটি একটি করে দেন। খানিকটা আদেশের সুরে। নামার পর লাগেজের জন্য অপেক্ষা করতে হলো অনেকক্ষণ।
বাংলাদেশ বিমানের বহরে নতুন নতুন প্লেন যুক্ত করে বহর বাড়ানো হচ্ছে। রুটের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু তাদের সেবার মান রয়ে গেছে সেই পুরনো ধাঁচের। আবার শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের পরিধিও বাড়ানো হয়েছে কয়েকগুণ।
কিন্তু ইমিগ্রেশন পুলিশের আচরণ ও কথাবার্তা বিভ্রান্তিমূলক। নেপালগামী যাত্রীদের কয়েকজনকে আটকে দেওয়া হলো পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স না থাকায়। বলা হলো ডলার এনডোর্স না থাকলে নেপাল থেকে ফেরত পাঠাবে। বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন ইমিগ্রেশনের পরিদর্শকও। ওই যাত্রীরা বললেন, আমরা ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে যাচ্ছি, সবকিছু পেমেন্ট করা আছে। তারপরও ইমিগ্রেশন পুলিশ একই কথা বলতে থাকলেন। যাত্রীরা নিজ দায়িত্বে নেপাল গেলেন, বললেন আমরা যাচ্ছি ফেরত দিলে দেবে। অবাক করার কাঠমান্ডু এয়ারপোর্ট এসবের কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। মুচকি হাসি দিয়ে ধপাধপ ভিসার স্টিকার দিয়ে দিলেন।
অত্যাধুনিক স্থাপনায় চোখ জুড়ালেও পেট ভরে না, অবকাঠামোর সঙ্গে সেবার মান বাড়ানো খুবই জরুরি। না হলে কোন এক যাত্রী লিখেছিলেন বি-মান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এ-মান হবে কবে। তার সঙ্গে একই সুরে বলতে হয় সেবার মান নিশ্চিত করা না এ-মান অর্জন করা দূরহ।