শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৬ অপরাহ্ন

ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট: বিমানের ক্ষতি হবে সপ্তাহে সোয়া ১১ কোটি টাকা

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

১৭ বছর বন্ধ থাকার পর ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে আবার ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। নিজস্ব দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯ উড়োজাহাজ দিয়ে সপ্তাহে পাঁচটি ফ্লাইট চালাতে চায় রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এই সংস্থা। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন দপ্তর থেকে ‘ফরেন এয়ার ক্যারিয়ার পারমিট’ পেতে সম্প্রতি আবেদনও করেছে বিমান। তবে এই অনুমোদন পাওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অথরিটি (এফএএ) থেকে ক্যাটাগরি-১ ছাড়পত্র পেতে হবে। বেসামরিক বিমান চলাচলসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিএওর সব মানদণ্ড পূরণ হলে এই ছাড়পত্র পাওয়া যায়।

বিমান নিউইয়র্কে সবশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করেছিল ২০০৬ সালের ৫ আগস্ট। লোকসানের কারণে এই পথে ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পুনরায় ফ্লাইট চালু করা হলেও বিমানকে সপ্তাহে প্রায় সোয়া ১১ কোটি বা বছরে ৫৮৪ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিতে হবে বলে বিমানের আবেদনের নথি থেকেই জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুল আজম আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই আয়-ব্যয়ের হিসাব চূড়ান্ত নয়। ফ্লাইট যখন চালু হবে, তখন পরিস্থিতি পাল্টাবে। যেসব বিষয় ধরে এই হিসাব করা হয়েছে, তার অনেক কিছু পাল্টে যেতে পারে। যখনকার তেলের হিসাব করা হয়েছে, তখন দাম অনেক বেশি ছিল, ডলারের বিনিময় হারও ছিল উচ্চ। তা ছাড়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের বিষয়েও খরচে পরিবর্তন আসার সুযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞ দিয়ে পুরো নিখুঁতভাবে আবেদন তৈরি করা হয়েছে।

নথিতে বলা হয়েছে, এই বছরের জুলাই মাসের ব্লক আওয়ার, তেলের দাম, মুদ্রার বিনিময় হারসহ যেসব তথ্যের ভিত্তিতে ব্যয়ের হিসাব ধরা হয়েছে, তা বাস্তবে পাল্টে যাবে।

নথি থেকে জানা যায়, ‘ফরেন এয়ার ক্যারিয়ার পারমিট’ পাওয়ার জন্য ৫ সেপ্টেম্বর বিমানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জনসন, রজার্স অ্যান্ড ক্লিফটন এলএলপি আবেদন জমা দিয়েছে। নথি অনুযায়ী, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তুরস্কের ইজমির বিমানবন্দর হয়ে জন এফ কেনেডি (জেএফকে) বিমানবন্দরে চলাচল করবে বিমানের ফ্লাইট। এই উড়োজাহাজে ২৯৮ জন যাত্রী এবং ১ হাজার ৫০০ কেজি মালপত্র বহন করা যাবে।

বিমানের নথিতে থাকা হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই রুটে রাউন্ড ট্রিপে যাত্রী ধরা হয়েছে ৪৭৬ জন, ভাড়া প্রায় ৮০০ ডলার। এর সঙ্গে কার্গো ও বাড়তি ব্যাগেজের আয় ধরে ঢাকা-নিউইয়র্ক রুট থেকে সপ্তাহে মোট রাজস্ব আয় হবে ২১ লাখ ১৭ হাজার ২৩৫ ডলার। সব মিলিয়ে ব্যয় হবে ৩১ লাখ ৪১ হাজার ২৪ ডলার। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে বিমানের লোকসান হবে ১০ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৯ ডলার বা প্রায় ১১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এক বছরে এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ কোটি ৩২ লাখ ৩৭ হাজার ১০ ডলার অর্থাৎ ৫৮৪ কোটি ৪১ লাখ টাকার বেশি।

এরোটাইম ডট এরোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই রুটে ফ্লাইট পরিচালনা লাভজনক না হলেও সরকার তার মর্যাদার প্রশ্নে উদ্যোগটি নিতে চায়।

লোকসানের কারণে বন্ধ হওয়ার আগে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে বিমান মোট ৭৯টি ফ্লাইট পরিচালনা করেছিল। তাতে মোট ১১ হাজার ৪৫৫ জন যাত্রী অর্থাৎ প্রতি ফ্লাইটে গড়ে ১৪৫ জন যাত্রী পরিবহন করা হয়েছিল।

বিশ্বের দীর্ঘতম এই আকাশপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ হাজার ৬৮১ কিলোমিটার, যা পেরোতে লাগে ৩৪ ঘণ্টা। বিমান চলাচলবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল সিম্পল ফ্লাইংয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিমানের এই ফ্লাইটটি জ্বালানি নেওয়া এবং ক্রু পরিবর্তনের জন্য তুরস্কের ইজমির বিমানবন্দরে বিরতি দেবে।

বিমানের নথি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ এখন এফএএ ক্যাটাগরি-২-এ আছে, অর্থাৎ বেসামরিক বিমান চলাচলের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিএওর সব মানদণ্ড পূরণ হয়নি। এফএএ পরিদর্শকদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বেবিচক এখনো আইসিএওর মানদণ্ড অনুযায়ী সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে বিমান মনে করে, এফএএ এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে ক্যাটাগরি-১ নিশ্চিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন বিভাগের (ডিওটি) কাছ থেকে পারমিট পাওয়া যাবে।

বেবিচকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ বছরের শেষ বা আগামী বছরের মার্চের মধ্যে এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে। বেবিচকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্যাটাগরি-১ ছাড়পত্র পাওয়ার বিষয়ে এফএএর সঙ্গে কাজ করছে বেবিচক। এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের মার্চের মধ্যে যেকোনো সময় এটা মিলতে পারে। তিনি জানান, ক্যাটাগরি-১ পাওয়ার জন্য এফএএর নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে বেবিচককে কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে বোয়িং। এই কোম্পানি ৫০০ ঘণ্টার পরামর্শ দিচ্ছে, যার মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

এর আগে ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফ্লাইট চালুর বিষয়ে বাংলাদেশ সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছিল। ওই সমঝোতা অনুযায়ী, এফএএর নিরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক্যাটাগরি-১ ছাড়পত্রধারী কোনো দেশ থেকে ‘ওয়েট লিজ’ বা স্বল্পমেয়াদি পদ্ধতিতে উড়োজাহাজ ভাড়া করে ফ্লাইট চালুর সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু বিমান ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।

সংস্থাটি ‘ড্রাই লিজ’ বা দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতিতে মিসরের ইজিপ্টএয়ার থেকে দুটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ ভাড়া আনে। যুক্তরাষ্ট্র তা গ্রহণ করেনি। পরে ওয়েট লিজ পদ্ধতিতে বিমান ভাড়ার চেষ্টা করা হলেও সফলতা আসেনি। এ কারণে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ রুটে টিকিট ছেড়েও পরে ফেরত নিতে বাধ্য হয় বিমান।

বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশনস বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারিগরি কমিটি এরই মধ্যে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। তারা শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে তদন্ত করেছে। কিছু উপদেশও দিয়ে গেছে। সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছে বেবিচক।

বেবিচকের সদস্য (নিরাপত্তা) আবু সালেহ মাহমুদ মান্নাফী জানান, ফ্লাইট সুরক্ষায় সমস্যা হলেও নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মান পূরণ করেছে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর জন্য তিনটি ধাপ আছে। প্রথমে পরিবহন বিভাগে আবেদন; দ্বিতীয়ত, এফএএর কাছ থেকে ক্যাটাগরি-১ ছাড়পত্র পাওয়া এবং সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের (টিএসএ) ছাড়পত্র লাগবে।

বিমানের নথিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ড অনুযায়ী নিরাপত্তা অর্জনের জন্য সব পক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চলছে। এফএএর অনুমতি পেলে নিয়ম অনুযায়ী, ফ্লাইট পরিচালনার অন্তত ৯০ দিন আগে প্রস্তাবিত নিরাপত্তা কর্মসূচি জমা দেওয়া হবে।

আবু সালেহ মাহমুদ মান্নাফী বলেন, এর মধ্যে টিএসএ পরিদর্শন শেষে ভালো বলে মূল্যায়ন করেছে। টিএসএর নিরীক্ষায় বিমানও যুক্ত ছিল। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালুর সঙ্গে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। টিএসএ থেকে নিরাপত্তা চেকপয়েন্ট বিষয়ে ১০ ধরনের পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো পূরণ করে টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে।

বিমানের সাবেক এমডি কাজী ওয়াহিদুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে এই ফ্লাইট বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা কমার্শিয়ালি ভায়াবল হবে না, এটা পলিটিক্যাল ডিসিসন।’ তিনি আরও বলেন, বাজার যাচাই না করে বিমান এই উদ্যোগ নিয়েছে। এটা না করে বড় এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে কোডশেয়ার বা পার্টনারশিপ করা যেত। অর্থাৎ চুক্তির আওতায় বিমানের কোড ও টিকিটধারী হিসেবে অন্য এয়ারলাইনসে যাত্রী পরিবহন করা যেত।

বিমান পারমিটের জন্য আবেদন করলেও এফএএর ক্যাটাগরি-১ ছাড়পত্র পাওয়া কঠিন বলে ওয়াহিদুল আলম মনে করেন। তিনি বলেন, ‘এর জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে স্বায়ত্তশাসিত হতে হবে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, রেগুলেটর ক্যান নট বি অপারেটর, এয়ারপোর্টের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বেবিচকই এয়ারপোর্ট চালায়।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com