আকাশযাত্রায় দিনবদলের স্বপ্ন দেখিয়ে বাংলাদেশের আকাশে ডানা মেলেছিল বোয়িংয়ের ড্রিমলাইনার এয়ারক্রাফটগুলো। অথচ মূল্যবান ও অত্যাধুনিক এ এয়ারক্রাফটগুলো নিয়ে এক ধরনের ছেলেখেলায় মেতেছে বিমান।
একটানা ২০ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম বিমানগুলোকে একটানা না চালিয়ে ‘কানেক্টিং ফ্লাইট’ হিসেবে ব্যবহার করে বাড়ানো হচ্ছে এর উড্ডয়ন-অবতরণের সংখ্যা। ফলে অর্ধেকে নেমে আসছে দামি এয়ারক্রাফটগুলোর আয়ুষ্কাল। শুধু আয়ুষ্কালই কমছে না, একই কারণে ব্যয়ও বাড়ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের।
বোয়িংয়ের ৭৮৭ ড্রিমলাইনার এয়ারক্রাফটগুলো বিশ্বের অত্যাধুনিক বিমানগুলোর অন্যতম। ঢাকা থেকে সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকা ও কানাডার মতো বড় দূরত্বের রুটে চলতে সক্ষম বিমানগুলো। অথচ বাংলাদেশে বিমানগুলোকে একটানা না চালিয়ে চট্টগ্রাম বা সিলেটে কানেক্টিং ফ্লাইটে ব্যবহার করা হচ্ছে।
যেমন- ঢাকা থেকে দুবাই যাওয়ার পথে বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনারকে অবতরণ করানো হয় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে। সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে বিমানটি আবার উড্ডয়ন করে দুবাইয়ের উদ্দেশে। একই কাজ করা হচ্ছে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ও লন্ডন রুটের ক্ষেত্রেও। এখানে ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পর সিলেটে অবতরণ করানো হয়। সেখান থেকে লন্ডনের উদ্দেশে পুনরায় উড্ডয়ন করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড্রিমলাইনার বিমানগুলো মূলত বড় রুটে চলাচলের উপযোগী। এটি টানা ২০ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম। চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো কম সময়ের রুটে উড়ে অবতরণ করার ফলে তাদের আয়ুষ্কাল কমে যাবে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে বর্তমানে ছয়টি ড্রিমলাইনার এয়ারক্রাফট রয়েছে। এর মধ্যে ৭৮৭-৮ মডেলের রয়েছে ৪টি এয়ারক্রাফট। এগুলো হলো- আকাশবীণা, হংসবলাকা, গাঙচিল ও রাজহংস। আর ৭৮৭-৯ মডেলের রয়েছে সোনার তরী ও অচিন পাখি নামে দুটি এয়ারক্রাফট।
কম দূরত্বে ওঠানামায় ‘ফ্লাইট সাইকেল’ কমে যাচ্ছে
ড্রিমলাইনারের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বোয়িং সূত্রে জানা যায়, বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার এয়ারক্রাফটগুলোর ৪৪ হাজার ‘ফ্লাইট সাইকেল’ রয়েছে। অর্থাৎ একটি এয়ারক্রাফট কেনার পর থেকে এটি ৪৪ হাজার বার উড্ডয়ন-অবতরণ করতে পারবে। একবার উড্ডয়ন করে অবতরণ করলে একটি সাইকেল শেষ হবে। শুধু ড্রিমলাইনার নয়, যেকোনো এয়ারক্রাফটই একবার উড্ডয়ন-অবতরণ করলে একটি সাইকেল শেষ হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঢাকা থেকে সরাসরি লন্ডনের ফ্লাইটে একটি ‘সাইকেল’ শেষ হবে। আবার ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে যাত্রী নিয়ে লন্ডন গেলে প্লেনটি লন্ডনে এবং সিলেটে দুবার অবতরণ করবে, ফলে বিমানটির দুটি ‘সাইকেল’ খরচ হবে। তাছাড়া ড্রিমলাইনার অত্যন্ত অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট, এটির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় এবং যন্ত্রাংশের দামও বেশি। তাই ছোট রুটে এ এয়ারক্রাফট চালানোর ফলে এটি বিমানের বড় ধরনের অর্থ অপচয়ের কারণ হবে।
ড্রিমলাইনারের ওড়ার সক্ষমতা কতটুকু
ফ্লাইট ওঠানামাসহ আকাশপথের বিভিন্ন রুট নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ফ্লাইট স্ট্যাটাস থেকে জানা যায়, বোয়িংয়ের ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পার্থ থেকে লন্ডনে ১৭ ঘণ্টা ১৫ মিনিট (কান্তাস এয়ারওয়েজ), মেলবোর্ন থেকে ডালাস ১৭ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট (কান্তাস এয়ারওয়েজ), অকল্যান্ড থেকে নিউইয়র্ক ১৭ ঘণ্টা ৫০ মিনিট (এয়ার নিউজিল্যান্ড) এবং ডারউইন থেকে লন্ডন ১৭ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের (কান্তাস এয়ারওয়েজ) ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়।
বিমান বাংলাদেশ একই মডেলের বিমানকে কানেক্টিং ফ্লাইট হিসেবে ব্যবহার করায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলোকে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের দূরত্ব অতিক্রম করেই অবতরণ করতে হচ্ছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিটি এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন সাইকেল এবং ল্যান্ডিং গিয়ারের সাইকেল থাকে (জীবদ্দশায় কতবার অবতরণ করতে পারবে)। এগুলো অনেক দামি যন্ত্রাংশ। ঢাকা থেকে সিলেটে বিমানগুলো অবতরণ করুক আর ঢাকা থেকে লন্ডন গিয়ে অবতরণ করুক, প্রত্যেকটি একটি অবতরণ হিসেবেই ধরা হবে। ফ্লাইট লম্বা সময়ের হোক বা কম সময়ের হোক, অবতরণ করলেই একটি ‘ল্যান্ডিং আয়ু’ কমে যাবে, ইঞ্জিনের আয়ু কমে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ইঞ্জিনও একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক অবতরণের পর চেক করতে হয়, সেটিও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এছাড়া উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় একটি প্লেনের সবচেয়ে বেশি তেল খরচ হয়। ‘শর্ট ল্যান্ডিং’ বিমানের ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ। আমরা যে বড় এয়ারক্রাফট নিয়ে যাচ্ছি, আদৌ কি কোনো লাভ হচ্ছে আমাদের? যদি না হয়, তাহলে কেন এগুলো করব?
যে কারণে বিমানের চিন্তার কারণ হবে ড্রিমলাইনার
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে জানা যায়, একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর একটি এয়ারক্রাফটকে নানা ধরনের অডিট বা পরীক্ষা করা হয়। এয়ারলাইন্সের নানা যন্ত্রাংশ ঠিক আছে কি না, সেগুলো যাচাই করা হয়। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পরীক্ষা হচ্ছে সি-চেক ও ডি-চেক। প্রতি ১৮ মাস থেকে দুই বছর পরপর একটি এয়ারক্রাফটের সি-চেক করা হয়। এটি করতে প্রায় দুই সপ্তাহের মতো সময় লাগে। ডি-চেকে এয়ারক্রাফটের সব যন্ত্রাংশ খুলে প্রতিটি চেক করা হয়। এটি সাধারণত ১০ থেকে ১২ বছর বা এয়ারক্রাফটের লাইফ সাইকেল শেষ হওয়ার পর করা হয়। এতে খরচ হয় প্রায় ৬০ লাখ মার্কিন ডলার।
বিমানের ড্রিমলাইনারগুলো আনা হয় ২০১৮ ও ২০১৯ সালে। ডি-চেক করার জন্য আয়ুষ্কাল আনুমানিক ১০-১২ বছর ধরা হলেও বিমান ছোট রুটে লাইফ সাইকেল খরচ করায় অর্ধেক সময় অর্থাৎ ৬-৭ বছরের মধ্যেই ডি-চেক করাতে হবে। পাশাপাশি যদি ল্যান্ডিং গিয়ার আর ইঞ্জিনের লাইফ সাইকেল শেষ হয়ে যায় তাহলে এগুলোও নতুন করে কিনতে হয়। এ দুই যন্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রোলস রয়েস হোল্ডিংস পিএলসি জানায়, তারা বর্তমানে প্রতিটি ল্যান্ডিং গিয়ার ৭০ লাখ মার্কিন ডলার এবং ল্যান্ডিং গিয়ারের পুরো সেট ৮০ লাখ ডলারে বিক্রি করছে। পাশাপাশি প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম পড়বে দুই কোটি মার্কিন ডলার। সবমিলিয়ে বাংলাদেশি টাকায় ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা খরচ হতে পারে।
এর সমাধান কী— জানতে চাইলে কাজী ওয়াহিদুল বলেন, যদি সিলেট থেকে লন্ডন বা চট্টগ্রাম থেকে মধ্যপ্রাচ্যের রুটে যাত্রী বেশি থাকে সেক্ষেত্রে বিমান ছোট এয়ারক্রাফট দিয়ে তাদের ঢাকায় এনে ঢাকা থেকে লন্ডন বা দুবাই রুটে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক এয়ারক্রাফট সিলেট ও চট্টগ্রামের যাত্রী ঢাকায় এনে ঢাকা থেকে সরাসরি বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছে।
সব জেনেই ছোট রুটে যাচ্ছে ড্রিমলাইনার : বিমানের এমডি
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মো. শফিউল আজিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি অবশ্যই ঠিক, আমিও একমত। তবে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, লন্ডন-ম্যানচেস্টার ফ্লাইটের ৯০ শতাংশ যাত্রী সিলেটের, আমিরাতের এমন সংখ্যক যাত্রী চট্টগ্রামের। আমরা যদি সরাসরি সিলেট বা চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করতে চাই তাহলে সেসব বিমানবন্দরে ড্রিমলাইনার রাখতে হবে, পাশাপাশি ক্রু সেটাপও রাখতে হবে। কিন্তু ঢাকা ছাড়া কোনো এয়ারপোর্টের এখনও এসব সুযোগ-সুবিধা নেই। এছাড়া আমরা দেখেছি, সিলেট ও চট্টগ্রাম থেকে যারা ফ্লাই করেন তারা ঢাকায় এসে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে চান না, তাই ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে ছেড়ে সিলেট ও চট্টগ্রামে অবতরণ করে, তারপর মূল গন্তব্যে রওনা হয়।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে যদি সিলেট ও চট্টগ্রামের ফ্যাসিলিটি বাড়ে এবং আমরা সেখানে হাব করতে পারি, তাহলে ঢাকা থেকে কানেক্টিং ফ্লাইট দেওয়া যাবে।
এদিকে, বিমানের এমডি ‘অ্যানালাইসিস’-এর কথা বললেও খরচের বিষয়টি তিনি বিশ্লেষণ করেছেন কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ড্রিমলাইনারে চড়ে সিলেট ও চট্টগ্রামে যারা নেমে যাচ্ছেন তাদের কাছ থেকে বিমান ভাড়া নিচ্ছে ৩১৯৯ টাকা। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্রিমলাইনারের আয়ুষ্কাল বিবেচনা করে খরচ ধরলে চট্টগ্রাম বা সিলেটের ফ্লাইটে সিটপ্রতি ব্যয় হয় প্রায় ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ড্রিমলাইনার দিয়ে এমন ছোট ফ্লাইট পরিচালনা করায় বিমানের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
যদিও ব্যয়ের এ পরিমাণ সম্পর্কে কোনো বিশেষজ্ঞ বা বিমানের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি ঢাকা পোস্ট।
বিমানের বহরে বর্তমানে বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার চারটি, ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার দুটি, বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর চারটি, বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের ছয়টি এবং বোম্বারডিয়ার ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ মডেলের পাঁচটিসহ মোট ২১টি এয়ারক্রাফট রয়েছে।
বর্তমানে বিমান কুয়েত, কাতারের দোহা, সৌদি আরবের দাম্মাম, মদিনা, রিয়াদ, জেদ্দা, আরব আমিরাতের শারজাহ, আবুধাবি, দুবাই, ওমানের মাস্কাট, ভারতের দিল্লী, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ম্যানচেস্টার ও কানাডার টরন্টো রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুরে ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া স্বল্প দূরত্বে কলকাতা, কাঠমান্ডু রুটে ফ্লাইট নিয়মিত চলছে। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা থেকে জাপানের নারিতা বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনা করবে বিমান।
ঢাকা পোস্ট