ক্রেডিট কার্ডের গোপন তথ্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে চলে যায় প্রতারক চক্রের কাছে। এরপর প্রতারক চক্র ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ার নম্বর ক্লোন করে। ওই নম্বর থেকে গ্রাহকের কাছে ফোন দেওয়া হয়। গ্রাহককের নাম, কার্ড নম্বর, মেয়াদোত্তীর্ণের নম্বর জানানোর পর সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের কাছে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। এরপর গ্রাহকের কাছে ক্রেডিট কার্ডের পিনকোড চাওয়া হয়। গ্রাহক পিনকোড জানানোর পর কাস্টমার কেয়ার থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়। এরপর প্রতারক চক্র বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাপসে ঢুকে ওই ক্রেডিট কার্ডের তথ্য দিয়ে সব টাকা তার মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে স্থানান্তর করে নেয়।
ক্রেডিট কার্ডের গোপন তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়। এরপরও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কার্ডের গোপন তথ্য জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতারক চক্রের কাছে। রাজধানীর ডেমরার সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক-এসআইবিএলের এক ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের কাছে কাস্টমার সার্ভিস নম্বর থেকে ফোন আসে গত ১২ মার্চ। গ্রাহকের নাম, কার্ডের নম্বর, মেয়াদ উত্তীর্ণের নম্বর জানিয়ে নিরাপত্তার স্বার্থে চাওয়া হয় পিনকোড।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন শাখার উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তা কাবুল ২৩-২৪ জন গ্রাহকের তথ্যের প্রতিটি শিট হাসানের কাছে বিক্রি করতো ৭-৮ হাজার টাকায়। সেই তথ্য হাসান পাঠাতো চক্রের আরেক সদস্য রাব্বির কাছে। রাব্বি ব্যাংকটির হটলাইন নম্বর ক্লোন করে গ্রাহককে ফোন করে বলতেন, ‘এসআইবিএল থেকে বলছি। আপনার কার্ড আপডেট করার জন্য ব্যাংক থেকে এক কর্মকর্তা ফোন করবেন, তাকে সব তথ্য দিয়ে সহায়তা করবেন।’ এরপরই দ্বিতীয় ধাপে হাসান খান গ্রাহককে ফোন করে বলতেন, ‘আপনার মোবাইল ফোনে একটি নম্বর গেছে। সেটি জানান আমাকে।’ কৌশলে ওটিপি নম্বরটি নেওয়ার পরই কার্ড থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসছিলেন তারা। হাতিয়ে নেওয়া টাকার ৩০ শতাংশ রাব্বি এবং ৭০ শতাংশ পেতেন হাসান খান।
এবিষয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (জনসংযোগ) মনিরুজ্জামান টিপু বলেন, কাবুল হাসান রশিদ চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা ছিলেন। ইতোমধ্যে তার চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
‘লংকাবাংলা ফাইন্যান্স থেকে বলছি স্যার, আপনার কার্ডটি আপাতত বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের দেওয়া পাসওয়ার্ড আপনি পরিবর্তন করেননি। তাই আপনার ক্রেডিট কার্ডের শেষের চার ডিজিট বলুন এবং আপনার পাসওয়ার্ডটি পরিবর্তন করুন।’ আর্থিক প্রতিষ্ঠান লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের কর্মকর্তা পরিচয়ে এক ব্যক্তি ফোন করে গ্রাহক তামান্না আফরোজের কাছে এভাবেই তার ব্যাংক হিসাব-সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে নেন। পরে গ্রাহকের ক্রেডিট কার্ড থেকে সব টাকা উঠিয়ে নেয়। ঘটনাটি ঘটে গত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে।
গত ডিসেম্বরে মিরপুর মাজার রোডের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলায়মানের ভিসা ক্রেডিট কার্ড থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্র। এ ঘটনায় ৩১ জানুয়ারি তিনি দারুস সালাম থানায় একটি জিডি করেন।
জিডিতে তিনি অভিযোগ করেন, ২৩ ডিসেম্বর এক ব্যক্তি লংকাবাংলার কর্মকর্তা পরিচয়ে ফোন করে তাকে ভিসা ক্রেডিট কার্ডের হালনাগাদ করার জন্য কিছু তথ্য জানতে চান। ২৬ ডিসেম্বর তিনি জানতে পারেন, ৩০ হাজার টাকা করে ছয় ধাপে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির লিটিগেশন ডিপার্টমেন্টের সহকারী কর্মকর্তা রজত রায় বাদী হয়ে গত ২১ মার্চ বনানী থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত প্রতারক চক্রকে আসামী করা হয়েছে।
সম্প্রতি বছরগুলোতে এটিএম কার্ড স্কিমিং, কার্ড ক্লোনিং ও সর্বশেষ ‘জ্যাকপট’ ম্যালওয়্যার দিয়ে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সালে পোলান্ডের নাগরিক পিউটর কার্ড স্কিমিং ডিভাইস দিয়ে কয়েক কোটি টাকা চুরি করে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। ২০১৯ সালে ছয় ইউক্রেনীয় নাগরিক ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে প্রায় ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করার ছয় মাস পর তারা জামিনে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।