অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম (এপিআইএস) হচ্ছে একটি উন্নত প্রযুক্তি, যা আকাশপথে যাত্রী, ক্রু এবং বিমানের সব ধরনের তথ্য যাতায়াতকারী দুই দেশের কর্তৃপক্ষকে আগেই সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে কোনো ফ্লাইট দেশে পৌঁছানোর আগেই সংশ্লিষ্ট সবার তথ্য এপিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে চলে আসবে সার্ভারে। সেই তথ্য যাচাই করে সহজেই অপরাধী শনাক্ত ও ব্যবস্থা নিতে পারবে সংশ্লিষ্টরা।
বিমান, বিমানবন্দর ও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ও বেসামরিক বিমান চলাচল বিষয়ক আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ (আইকা)ও তার সদস্য দেশগুলোর জন্য এ উন্নত প্রযুক্তি স্থাপন বাধ্যতামূলক করেছে। আইকাওয়ের সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশে ২০২৪ সালের মধ্যে এ প্রযুক্তি স্থাপন করার নির্দেশনা রয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় এবং বেবিচক দেশের সব বিমানবন্দরে এপিআইএস প্রযুক্তি স্থাপন করার লক্ষ্যে কাজ করছে। শিগগিরই এটা স্থাপন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ সিস্টেমে অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও তা বাদ দেওয়া হচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে জিটুজি ভিত্তিতে সিস্টেমটি স্থাপনের কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত আর্থিক প্রস্তাব দিয়েছে এবং তাদের মনোনীত প্রতিষ্ঠান ‘ইটিইকে’ কারিগরি প্রস্তাব দিয়েছে। আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য বেবিচকের সদস্য (নিরাপত্তা) এয়ার কমোডর মোহাম্মাদ নাইমুজ্জামান খানকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি গত সপ্তাহে ইটিইকে এর কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়ন করে অভিমত দিয়েছে যে, বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোয় এপিআইএস বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে যাত্রী চলাচলকে বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই। ফলে অভ্যন্তরীণ যাত্রীরা এর আওতামুক্ত থাকছেন। সিস্টেমটির প্রধান ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এ সিস্টেমের উপাত্ত ব্যবহার করতে পারবে। সিস্টেমটির সঙ্গে প্যাসেঞ্জার নেম রেকর্ড (পিএনআর) এবং ইলেকট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশন (ইটিএ) প্রযুক্তিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
আকাশপথ ব্যবহার করে কোনো যাত্রী বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া এবং অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে আসার আগেই ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে সেই যাত্রী, ক্রু ও বিমানের নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট নম্বর, জাতীয়তা, জন্ম তারিখ, পাসপোর্ট এবং ভিসার বিবরণ, মূল দেশ, গন্তব্য, ভ্রমণসহ বিস্তারিত তথ্যসংবলিত একটি তালিকা ফ্লাইট উড্ডয়নের আগেই ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে চলে আসবে।
ফলে অপরাধী, অনাকাক্সিক্ষত বা বিপজ্জনক যাত্রীর আগমনের বিপরীতে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আগাম প্রস্তুতির সময় পাবে এবং এমনকি বিদেশের বিমানবন্দরে বোর্ডিংয়ের সময় চিহ্নিত যাত্রীর যাত্রাও বাতিল করতে পারবে। এতে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সম্প্রসারিত হবে। সিস্টেমের প্রবর্তন করা হলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও অপরাধ দমন সহজতর হবে। এ ছাড়া অর্থপাচার, মাদক চোরাচালান ও মানবপাচার প্রতিরোধেও সিস্টেমটি সহায়ক হবে। একই সঙ্গে নিরীহ সাধারণ যাত্রীদের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ছাড় কার্যক্রম দ্রুত ও সহজতর হবে।
এপিআইএস সিস্টেমটি যাত্রীদের তথ্যাদি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ওয়াচলিস্টের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে। এ বিশ্লেষণের পরিসর অত্যন্ত ব্যাপক, যাত্রীর নাম ও অন্যান্য তথ্যের বানানে সম্ভাব্য পার্থক্যগুলোও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে।
টিকেট কেনার সময়, সিট রিজার্ভেশন বা চেক-ইন করার সময় পাসপোর্ট এবং ভিসার মতো ভ্রমণ নথি থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং জঙ্গি ও অন্য অপরাধীদের অবাধ বিচরণ রোধে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন যাত্রীদের শনাক্ত করে ভ্রমণ রোধ ও গ্রেফতার করতে সক্ষম হবেন।
এপিআইএস ইন্টারপোল এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জারি করা মোস্ট ওয়ান্টেড বা রেড অ্যালার্ট বা ওয়ারেন্টের মতো তথ্য যাচাই করতেও সক্ষম হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চোরাচালান রোধে এপিআইএস কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ফলে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে চোরাচালানের ঘটনা রোধে সহায়ক হবে।
সিস্টেমটি সব যাত্রী, ক্রু এবং অন্যান্য এয়ারলাইন্স কর্মীদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ এবং প্রস্থান করার ইলেকট্রনিক ডাটাবেস হিসেবে কাজ করবে।
বেবিচকের বোর্ড সদস্য (নিরাপত্তা) এয়ার কমোডর মোহাম্মাদ নাইমুজ্জামান খান বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এপিআইএস প্রযুক্তি স্থাপনে যে আর্থিক প্রস্তাব দিয়েছে তা বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রণালয়ে এখনও প্রক্রিয়াধীন। এখনও ডিসিশন হয়নি, হবে, তারপর জানা যাবে কবে এটা স্থাপন করা হবে। এটা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এ বিষয়ে একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা কাজ করছে।
তিনি বলেন, আইকাওয়ের সদস্যদের এটা ২০২৪ সালের মাধ্যে তাদের সিস্টেমের সঙ্গে ইনস্টল করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশ আইকাওয়ে স্বাক্ষরকারী দেশ হওয়ায় বাংলাদেশকেও এটা মেনে চলতে হবে।
নাইমুজ্জামান খান বলেন, এ উন্নত প্রযুক্তি স্থাপন করা হলে কোন যাত্রী যাচ্ছে-আসছে, কোন দেশে যাচ্ছে, তার ভিসা আছে কি না এর মাধ্যমে তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে। সেই দেশও আগে থেকে জেনে যাবে সেই যাত্রীর সব তথ্য সম্পর্কে।
তিনি বলেন, এ প্রযুক্তি স্থাপন হলে অপরাধী এবং অনাকাক্সিক্ষত যাত্রী শনাক্তে উভয় দেশের জন্য সুবিধা হবে। আমরা ২০২৪ সালের মধ্যেই এ প্রযুক্তি স্থাপন করতে চাই।
এর আগে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী গণমাধ্যমে বলেন, বিমানপথে অপরাধী শনাক্তে দেশের সব বিমানবন্দরে বসবে অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম, যার মাধ্যমে দেশে ফ্লাইট পৌঁছার আগেই যাত্রীর তথ্য চলে আসবে বিমানবন্দরে।
গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এপিআইএস প্রতিষ্ঠার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে একটি এমওইউ (মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) স্বাক্ষর করে।