তিনি বলেন, ‘সুপারসনিক গতিতে বিমানের কার্যক্ষমতা বাড়াতে এর ডানাগুলো বিশেষভাবে ডিজাইন করা হলে দেখা যায়, তা ধীর গতিতে বিমানকে যথেষ্ট লিফট বা ঊর্ধ্বমুখী বল দিতে পারছে না। ফলে উড্ডয়ন বা অবতরণের বিষয়টি সমস্যা তৈরি করে।’ ড্র্যাগ বা উল্টোদিকে বাতাসের ঘর্ষণ বল কমানোর জন্য সুপারসনিক বিমানগুলোর পাখা সাধারণত পাতলা করে বানানো হতো। অন্যদিকে সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানের পাখাগুলো হয় অপেক্ষাকৃত পুরু। ফলে এরা বেশি উর্ধ্বমুখী বল প্রয়োগ (লিফট) করতে পারে বিমানে।
বিমানে পর্যাপ্ত উর্ধ্বমুখী বলের জোগান দেওয়া জরুরি। কারণ, বিমান যত দ্রুত যায়, বিপরীত থেকে বাতাসের ঘর্ষণ বল বা বাঁধা বেশি কাজ করে। ফলে এই বাঁধাকে প্রতিহত করে আকাশে উড়লে সুপারসনিক বিমানগুলোতে বেশি উড্ডয়ন বল বা লিফটের প্রয়োজন পড়ে।
এ সমস্যার সমাধান করতে প্রকৌশলীরা কনকর্ড বিমানকে মসৃণ ও সরু আকৃতিতে নতুনভাবে ডিজাইন করেন। এতে যাত্রীদের কেবিন সংকুচিত হয়ে যায়। অন্যদিকে লেজের দিকটা বেড়ে কোণ আকৃতির হয়ে যায়। প্রকৌশলীরা এতে ডেল্টা উইং নামে বিশেষ আকৃতির ডানা ব্যবহার করেন। এ ধরনের ডানাগুলো সাধারণত ফাইটার জেট বিমানেই ব্যবহৃত হতো।
ডেল্টা উইংগুলো দারুণভাবে উচ্চগতি এবং কমগতির পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। ত্রিভুজ আকৃতির এ পাখাগুলো বিপরীত দিক থেকে আসা বাতাসের বাঁধা কমাতে সাহায্য করে। এতে অবশ্য পুরো বিমানের আকৃতিটা একটু অদ্ভুত দেখায়। যা-ই হোক, এ কারণে অবতরণের সময় বিমানের সামনের অংশ সাধারণ বিমানের চেয়ে উঁচুতে থাকে। ফলে বিমান চালকের জন্য রানওয়ে দেখা কঠিন হয়ে যায়।
এ সমস্যা সমাধানে কনকর্ড বিমানের সামনের অংশ মূল দেহের চেয়ে কিছুটা নিচের দিকে বাকানোভাবে তৈরি করা হয়। বাণিজ্যিক ভাষায় এ ধরনের বিমানের সামনের অংশকে বলে ড্রপ স্নুট। ফলে রানওয়েতে নামার সময় চালক তার সামনের পথ পরিষ্কারভাবে দেখতে পারেন। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে ৬০-এর দশকে এভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল এসব বিমান।
তবে বর্তমানের সুপারসনিক বিমানগুলোতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সমস্যার সমাধান করা হয়। নির্মাণাধীন ‘বুম সুপারসনিক এক্সবি-১’ বিমানে অগমেন্টেড ভিশন সিস্টেম (ক্যামেরা ও স্ক্রিন) ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বিমানের সামনের অংশ নিচের দিকে বাঁকানো ছাড়াই পাইলট রানওয়ে পরিষ্কারভাবে দেখতে পাবেন।
এবারে গতির রহস্যটা বলা যাক। অদ্ভুত ডিজাইনের কনকর্ড বিমানগুলোকে শব্দের দ্বিগুণ গতি দেওয়ার জন্য চারটা টার্বো জেট ইঞ্জিন ব্যবহৃত হতো। প্রত্যেকটি ইঞ্জিন তৈরি করত ১৮.৭ টন থ্রাস্ট। এ জন্য প্রতি ঘণ্টায় পুড়ত প্রায় ২৬ হাজার লিটার জেট ফুয়েল (জেট ইঞ্জিনের জন্য কেরোসিন থেকে তৈরি বিশেষ ধরনের জ্বালানি তেল)। অন্যদিকে বোয়িং ৭৩৭ থেকে ৮০০ মডেলের বিমানগুলো মাত্র ৩ হাজার ২০০ লিটার জ্বালানি পোড়ায় প্রতি ঘণ্টায়।
শক্তিশালী চারটি জেট ইঞ্জিনই শুধু সুপারসনিক কনকর্ড বিমানের গতির একমাত্র কারণ নয়। থ্রাস্টের পরিমাণ বাড়াতে এসব বিমানে ব্যবহার করা হতো আফটার বার্নার নামে বিশেষ এক যন্ত্র। উচ্চগতিসম্পন্ন বোমারু বিমান কিংবা যুদ্ধবিমানে সাধারণত আফটার বার্নার ব্যবহার করা হতো। এটা মূল ইঞ্জিনের থেকে বেরোনো উচ্চগতির শিখায় জ্বালানি তেল ঢালে। বাংলায় যাকে বলে আগুনে ঘি ঢালা। আফটার বার্ন ডিভাইসের তেল ঢালার শিখার গতি আরও বেড়ে যায়। বিমানকে আরও জোরে সামনের দিকে ধাক্কা দেয়। সার্বিকভাবে বিমানের গতি বাড়ে। কিন্তু জ্বালানি খরচ হয়ে যায় আকাশচুম্বী।
জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ার অর্থ বিমানযাত্রা ব্যয়বহুল হওয়া। কনকর্ড বিমানগুলো বাণিজ্যিকভাবে সফল না হওয়ার এটি একটি কারণ। এছাড়া ২০০০ সালে এয়ার ফ্রান্সের একটি বিমান ‘ফ্লাইট ৪৫৯০’ মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়। কনকর্ড বিমানের বাণিজ্যিক অগ্রযাত্রার রাশ টেনে ধরার এটাও একটা কারণ। তাই অনেক দ্রুতগামী হওয়া সত্ত্বেও সুপারসনিক কনকর্ড বিমানগুলো সাধারণ যাত্রীদের নাগালের মধ্যে আর আসেনি। ফলে যাত্রা শুরুর মাত্র তিন দশকের মধ্যই বাণ্যিজিক যাত্রার ইতি ঘটে কনকর্ড বিমানের।