প্রায় ১৬ বছর আগে, ২০০৮ থেকে ১০ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে ভারতের প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকগুলো যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। গণতন্ত্রের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে আরও অনেক বিস্ময়কর সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল তখন। সে সময় আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারের বিভাগীয় প্রধান হিসাবে দায়িত্বরত ছিলাম। সে সময় ভারত তার প্রতিবেশী অঞ্চলে ইতিবাচক অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল।
বাংলাদেশে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল মইন উ আহমেদের অধীনে দুই বছরের সামরিক শাসন শেষ হয়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন বিশাল জনসমর্থন নিয়ে। বিশেষ করে তাঁর প্রতি নারী ও তরুণদের সমর্থন ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপমুক্ত বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নীরব ‘অনুঘটক’-এর ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরপর ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে, ভারত ও বাংলাদেশ পারস্পরিকভাবে উপকারী এক অংশীদারত্ব গড়ে তোলে। শেখ হাসিনার সরকার ভারতের মূল স্বার্থের প্রতি দেখায় সংবেদনশীলতা।
২০০৯ সালের মে মাসে ৩৩ বছর ধরে লড়াই করে অভিজ্ঞ ছিল লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই)। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের টেকসই সম্পৃক্ততার কারণে তারা পরাজিত হয়। ভারতের এই ভূমিকা যথোপযুক্ত রকম স্বীকৃতি পায়নি। মাথার ওপর এলটিটিইর তলোয়ার না থাকলে ভারত ঐক্যবদ্ধ এক শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সহজেই গড়ে তুলতে পারে।
২০০৮ সালের অক্টোবরে মালদ্বীপে, প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের ৩০ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের সমাপ্তি ঘটে। সেখানে প্রথম বহুদলীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন মোহাম্মদ নাশিদ। ভারত এই নবজাতক গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করার জন্য চেষ্টা করে যায়। বহু রাজনৈতিক উত্থান-পতন ঘটে মালদ্বীপে। পরপর তিনটি নির্বাচনে তিনজন প্রেসিডেন্ট আসেন দেশটিতে। গত ১৬ বছরে গড়ে ওঠা মালদ্বীপের গণতান্ত্রিক পরিপক্বতা অবহেলা করার মতো ব্যাপার নয়।
২০ বছরের সামরিক শাসনের পর ২০১০ সালে মিয়ানমারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনে সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ক্ষমতায় আসে। কারাবাস থেকে মুক্তি পান অং সান সু চি। পরবর্তীকালে তাঁর ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ২০১৫ এবং ২০২০ সালে বিরাট ব্যবধানে জয়লাভ করেছিল। এসব ঘটনা থেকে মনে হচ্ছিল যে সেখানে গণতান্ত্রিক ভিত্তি শক্তিশালী হবে।
সবচেয়ে অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিল পাকিস্তানে। সেখানে ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে নির্বাসনে পাঠিয়ে জনগণ একটি বেসামরিক সরকার নির্বাচিত করে।
এসব ঘটনা থেকে আশা জেগেছিল যে যতই অপূর্ণ হোক, গণতন্ত্র ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোয় শিকড় গেড়েছে। ২০০৮-১০ সালের বছরগুলোয় প্রতিবেশীদের প্রতি ভারতের উন্নয়ন সহায়তার তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। উত্তর শ্রীলঙ্কার পুনর্নির্মাণে সহায়তা বা বাংলাদেশে ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, মিয়ানমারে সংযোগ প্রকল্প, মালদ্বীপে নবজাতক গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করার জন্য বাজেট-সহায়তা—এ রকম বেশ কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়। একবারের জন্য হলেও ভারত তার প্রতিবেশী অঞ্চলে চীনের ‘চেকবুক কূটনীতির’ সঙ্গে পাল্লা দিতে পেরেছিল।
কিন্তু আজকে ২০১৪ সালে এসে এই প্রতিবেশী দেশগুলোকে যেন আর চেনাই যাচ্ছে না।
পরপর অনুষ্ঠিত হওয়া চারটি নির্বাচন বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে অপ্রতিরোধ্য করবে বলে যখন মনে হচ্ছিল, তখনই ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটল। সেই পতন ঘটল গণতন্ত্রের ঘাটতি, অর্থনৈতিক মন্দা আর ছাত্রবিক্ষোভের বিরুদ্ধে সহিংসতার ভারে। এর জন্য ভারত মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
ভারত কি এসব ঠেকাতে পারত? এর উত্তর হয়তো ‘হ্যাঁ’ হতে পারত, যদি তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘটত। কিন্তু কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে, বিশেষ করে যেখানে দুই পক্ষের জাতীয় স্বার্থের প্রতি বোঝাপড়া থাকে, তখন একজন নেতাকে পথ পরিবর্তনের জন্য কতটা চাপ দেওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করা কঠিন। শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে আলোচনা আছে। আসুন, আমরা বাস্তববাদী হই। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংযোগের মতোই ব্যক্তিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শেখ হাসিনা ও তার দলের পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্যান্য দলের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক বজায় রাখতে ভারতকে কেউ বাধা দেয়নি। ভারত কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় এমন এক বাংলাদেশ মুহূর্ত নেমে এসেছিল। অরাজনৈতিক জনসাধারণ আর তরুণদের নেতৃত্বে সংগঠিত সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ থেকে পালান। সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্র এবং অর্থনীতি ভীষণ মার খেয়ে যায়।
সেই প্রভাব এখনো শ্রীলঙ্কায় অনুভূত হচ্ছে। ভারত কি এটা আন্দাজ করতে পেরেছিল আগে থেকে? সে সম্ভাবনা খুবই কম। তবে এর পরে ভারত যা করেছে, তা প্রশংসনীয়। ভারতের প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের সময়োপযোগী এবং উদার বেল আউট প্যাকেজ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে বাঁচিয়েছে।
ভারত শ্রীলঙ্কায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মাত্রায় সেতুবন্ধ করেছে। তাই আসন্ন নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, ভারত এখন সেখানে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। এমনকি ভারতবিরোধী বলে পরিচিত ডানপন্থী দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনার সঙ্গেও ভারত শান্তি স্থাপন করেছে।
মালদ্বীপে নির্বাচন হলো ২০২৪ সালে। নির্বাচনের ফলাফলও ছিল ভারতের জন্য অপ্রত্যাশিত। সেখানেও ভারত প্রায় বাংলাদেশের মতো একই ভুল করেছিল। প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর বিশাল জয়ের জন্য নয়াদিল্লি প্রস্তুত ছিল না। তাই তাঁর সঙ্গে আগে থেকে কোনো সংযোগও গড়ে তোলেনি। ভারত এখন সেই ভুল সংশোধন করছে। মালদ্বীপের প্রথম নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট নাশিদ (২০০৮-১২) পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সমস্যায় পড়েছিলেন।
লক্ষণীয়, ভারত তখন প্রেসিডেন্ট নাশিদকে জোট গড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে পরামর্শ দিতে দ্বিধা করেনি। তবে নাশিদ সেই পরামর্শ শোনেননি। পরে তাঁকে প্রেসিডেন্টের পদ হারাতে হয়। বন্ধুদের ‘ভুলগুলোর’ প্রতি চোখ বুজে রাখার কোনো সুযোগ কি আর আছে ভারতের?
এবার মিয়ানমারের প্রসঙ্গে আসা যাক। পরপর তিনটি নির্বাচনের পর ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করে। যদিও ২০২১-এর নির্বাচনে এনএলডি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী এখন চড়ে বসেছে বাঘের পিঠে। নামতে পারছে না। বিরোধী আর জাতিগোষ্ঠীগুলো ক্রমেই পায়ের নিচের জমিন আরও শক্ত করছে। সংঘাত ভারতের উত্তর-পূর্বে এসে পৌঁছে গেছে।
ভারত পড়ে গেছে উভয়সংকটে। সে কি মিয়ানমারের মাটি ব্যবহার করে বিদ্রোহীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে থাকবে, নাকি পরিবর্তনের জন্য যুদ্ধরত বিরোধী শক্তির পাশে থাকবে? এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে সে তো মিয়ানমারকে হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিও নিতে পারবে না।
২০২১ সালের আগস্টে, তালেবানরা আফগানিস্তানে ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দুই দশক পর জোর করে ক্ষমতা দখল করে। ভারত এর পূর্বাভাস পেয়েছিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্কও করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার ‘কৌশলগত’ অংশীদার ভারতকে তালেবানের সঙ্গে কোনো সংযোগ স্থাপন থেকে দূরে রাখে, পাছে তা আবার পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করে। ভারত এখনো সেই ধাক্কা সামলাচ্ছে।
পাকিস্তানে ২০২২ সালে বেসামরিক সরকারের পতন ঘটেছে। অতীতের মতো এবারও তা সেনাবাহিনীর নির্দেশে ঘটেছে বলে সবাই মনে করে। তাই কিছু ক্ষেত্রে, ভারতকে তার ভুল পদক্ষেপ এবং ভুল ধারণার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে। আবার অন্য ক্ষেত্রে, ভারতের কোনো দোষ ছাড়াই, ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সেসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, সেটাই মূল বিষয়।
কলম্বোয় যখন ভারতের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন শ্রীলঙ্কাকে আর্থিকভাবে বেল আউট করার বিষয়টি বিবেচনা করে ভারত খুব একটা খারাপ করেনি। মালদ্বীপের নতুন সরকারের প্রতি ধৈর্য ধরে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে সেই সরকারের পায়ের নিচের জমিন শক্ত হওয়ার কাজ সহজ হবে। ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে ব্যবসা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে ভারত। নেপালের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা ভারতের দিকেই বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। অস্থিতিশীল কিন্তু গণতান্ত্রিক নেপালের দিকে ভারত আবার বাড়িয়েছে বন্ধুত্বের হাত।
মিয়ানমার আর বাংলাদেশে ভারত গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। মনে রাখতে হবে যে এই দুই দেশে ভারতের স্বার্থ খুবই গুরুত্ব বহন করে। মিয়ানমার ঝুঁকছে সম্ভাব্য এক গৃহযুদ্ধের দিকে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক জমিন ফিরে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে। উভয় ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক জমিন উন্মুক্ত রাখার চেষ্টা করছে যে শক্তি, তাদের সঙ্গে চলাই হবে ভারতের জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী এবং এনএলডির সঙ্গে এক অস্বস্তিকর সম্পর্কে আছে ভারত। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতিগত গোষ্ঠীগুলোও। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের ভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে ভারতের একটি নতুন বোঝাপড়া দরকার। তাদের সবাই যে ভারতের পক্ষে, এমন নয়। সেই বোঝাপড়া এমন হতে হবে বহিরাগত যে ভারতবিরোধী শক্তি পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, তারা যেন সফল না হয়।
এসব দোলাচলের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ এবং তাদের জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতের শক্তিশালী উন্নয়ন সমর্থনের গুরুত্বকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এমনকি তালেবান দুই দশক ধরে ভারতীয় প্রকল্পগুলোয় আক্রমণ করতে দ্বিধা করেছিল। কারণ, প্রকল্পগুলো জনগণকে উপকৃত করেছিল।
এ সবকিছু ইঙ্গিত দেয় যে প্রতিবেশীদের সঙ্গে এবং এ অঞ্চলে ভারতের আরও টেকসই সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। ভারত নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে যে গণতন্ত্রের জিন একবার মুক্ত হয়ে গেলে তাকে আর বোতলে ফিরিয়ে আনা কঠিন।