কানাডাসহ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি হওয়া নানা ব্র্যান্ডের পোশাক বাজার থেকে তুলে নিতে বলা হয়েছে বলে একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশের পর এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্র্যান্ড কোম্পানির চাহিদা, নমুনা এবং নির্দেশিত উপকরণ দিয়েই বাংলাদেশি কারখানাগুলো পোশাক তৈরি করে সরবরাহ করে। ফলে পোশাক প্রত্যাহারের সাথে কারখানাগুলোর আসলে কোন দায় বা সংশ্লিষ্টতা নেই।
বাংলাদেশে একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১২টি দেশ থেকে নানা ধরনের পোশাক প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছে সেসব দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পোশাকগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে- এই আশঙ্কা থেকে বাজারে থাকা এসব পোশাকের বিক্রি বন্ধ রাখতে হয়েছে।
সেইসাথে এরইমধ্যে যেসব পণ্য বিক্রি হয়ে গিয়েছে সেগুলো ভোক্তাদের কাছ থেকে ফেরত নেয়ার নির্দেশও দেয়া হয়েছে।
তবে বাজার থেকে পণ্য তুলে নেয়ার এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের কোন দায় নেই বলে জানিয়েছেন তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিজিএমইএ বলছে, ক্রেতারা অর্ডার দেয়ার সময় পণ্যের যাবতীয় বিবরণ দিয়ে থাকে এবং সেই অনুযায়ী পণ্য বানানো হয়। এরপর নমুনা পাঠানো হলে সেটির অনুমোদনের পর মালামাল শিপমেন্ট করা হয়। স্যাম্পল অনুযায়ী পণ্য না পাঠানো হলে অর্ডারই বাতিল হয়ে যেতে পারে। ফলে এক্ষেত্রে বাংলাদেশি কারখানাগুলোর কোন দায় নেই।
তাদের দাবি, বাংলাদেশ থেকে যখন বিদেশে পণ্য যায়, তখন সেটি সব ধরনের মান উত্তীর্ণ হয়ে ক্রেতাদের চূড়ান্ত অনুমোদন শেষেই পাঠানো হয়।
যেসব পোশাক প্রত্যাহারের কথা বলা হচ্ছে, এমনকি সেসব পোশাকের দামও মিটিয়ে দিয়েছে ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো। এখন সেই কারখানায় ডিজাইনে কিছুটা পরিবর্তন এনে ওই ব্র্যান্ডের পোশাকের উৎপাদন চলছে বলে জানানো হয়েছে।
কিন্তু বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমে বাজার থেকে তুলে নেয়া এসব পণ্যের প্রস্তুতকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম প্রচার করায় এই শিল্পে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, এট একটি ভুল সংবাদ।
তবে এ ধরনের ঘটনা একেবারে নতুন কিছু নয়। উন্নত দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানা কারণে অনেক সময় বিভিন্ন পোশাক ও পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে থাকে। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পোশাক, প্রসাধনী পণ্য বাজার থেকে তুলে নেয়ার উদাহরণ হয়েছে।
সর্বশেষ কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটে, জর্জ ব্র্যান্ডের শিশুদের গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা স্লিপার জাতীয় পোশাকটি এ পর্যন্ত যা বিক্রি হয়েছে, তা ক্রেতাদের থেকে পূর্ণ অর্থ পরিশোধ বাবদ ফেরত নিতে বলা হয়েছে চেইনশপ ওয়ালমার্টকে।
গত চৌঠা অক্টোবরের ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জর্জ ব্র্যান্ডের এই স্লিপারগুলো বারবার ধোয়ার কারণে এর জিপার পুল এবং পায়ের গ্রিপ পড়ে যেতে পারে বা সরে যেতে পারে।
এতে জিপার চেপে গিয়ে শিশুর দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেইসাথে খুলে আসা পায়ের গ্রিপের টুকরাগুলো শিশুর মুখে চলে যেতে পারে।
এসব কারণ দেখিয়ে ভোক্তাদের অবিলম্বে এই স্লিপার ব্যবহার বন্ধ করা উচিত বলে কানাডার ওই ওয়েবসাইটে আহ্বান জানানো হয়।
যদিও ২১শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, কোম্পানিটি কানাডায় এ ধরনের কোন ঘটনা বা স্বাস্থ্য সমস্যার অভিযোগ পায়নি।
কানাডা কনজিউমার প্রোডাক্ট সেফটি অ্যাক্ট অনুযায়ী একবার যে পণ্য প্রত্যাহার করা হয় সেগুলো ওই দেশে পুনরায় বিতরণ, বিক্রি বা এমনকি বিনামূল্যে দেয়াও নিষিদ্ধ।
এছাড়া ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের বাজার থেকেও এভাবে পোশাক সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সেদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
ওয়ালমার্টের স্টোরগুলোয় গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছর জুন পর্যন্ত অন্তত দুই লাখ ১৬ হাজারের বেশি পিস স্লিপার বিক্রি হয়ে গিয়েছে, যা এখন তাদের ফেরত নিতে হবে।
স্লিপারগুলো প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশের ইউনিক ডিজাইনার্স লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান এবং হংকংয়ের পিডিএস ফার-ইস্ট লিমিটেড সেগুলো বিতরণ করেছে বলে জানা যায়।
ইউনিক ডিজাইনার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ফরিদ আহমেদ জানিয়েছেন, তাদের গাজীপুরের কারখানায় জর্জ ব্র্যান্ডের ওই স্লিপারগুলো তৈরি করা হয়েছে।
এখানে জিপার নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে সেই জিপার ওয়ালমার্টের অনুমোদিত স্লিক কোম্পানির। সেইসাথে গ্রিপসহ পণ্যের সার্বিক সবকিছু মান পরীক্ষা শেষেই পাঠানো হয়েছে।
তাই কানাডার সরকার যে অভিযোগ তুলেছে তা নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্ততকারকদের কোন দায় নেই। এ নিয়ে ওয়ালমার্টও তাদের কাছে কোন অভিযোগ করেনি।
সৈয়দ ফরিদ আহমেদ বিবিসি বাংলাক বলেন, “সিঙ্গাপুরভিত্তিক বায়িং হাউস পিডিএস-ফারইস্ট লিমিটেড আমাদের পণ্যের গুনগত মান পরীক্ষা করে এরপর ওয়ালমার্টে পাঠায়।”
“পিডিএস আমাদের কাছে সমস্যার কথা বলেছে। আমরা বলেছি যে ওয়ালমার্ট যে মানের জিপার চেয়েছে আমরা সেটাই দিয়েছি। এখানে আমাদের কোন দায় নেই। ক্ষতি হয়েছে কোম্পানির” তিনি যুক্ত করেন।
বাংলাদেশের প্রস্ততকারকরা ইতোমধ্যে ওই অর্ডারের পেমেন্ট পেয়ে গিয়েছেন। তাই বাংলাদেশের এখানে কোন আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কাও নেই।
“ওয়ালমার্ট আমাদের অর্ডার দেয়া বন্ধ করেনি। আমাদের কারখানায় উৎপাদন চলছে। তবে এবার তারা আমাদের ভিন্ন রকম জিপার লাগাতে বলছে, আমরা সেটাই করছি।” বলেন মি. আহমেদ।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম বিবিসি বাংলাকে জানান, “ক্রেতারা অর্ডার দেয়ার সময় পণ্যের যাবতীয় বিবরণ দিয়ে দেয় এবং আমরা সে অনুযায়ী বানাই।”
“এরপর সব পণ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কোম্পানির কাছে স্যাম্পল (নমুনা) পাঠানো হয়। সেখানে অনুমোদন পেলেই পণ্যগুলো পাঠানো হয়।” তিনি বলেন।
মি. আজিম জানান, আমরা স্যাম্পল অনুযায়ী পণ্য তৈরি না করলে সমস্যা আমাদের, এক্ষেত্রে অর্ডারই বাতিল হয়ে যাবে, পণ্য বাজারে পৌঁছাবে না।
তার মতে, পণ্য বাজারে পৌঁছেছে মানে এটি মান উত্তীর্ণ হয়েই গিয়েছে।
“এক কথায় তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পণ্য তৈরির পর যদি সমস্যা হয় তাহলে সেই দায় আমাদের না।” তিনি বলেন।
এদিকে সোয়েটশার্ট বা ট্রাউজারের ফিতা জড়িয়ে দুর্ঘটনার যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে এখানেও বাংলাদেশের প্রস্ততকারকদের কোন দায় নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মি. আজিম বলেন, “পোশাকের ডিজাইন কেমন হবে, গলার মাপ, ফিতা থাকবে কি থাকবে না, সব তারা বলে দেয়, আমার শুধু তাদের ফলো করি। পণ্য একবার পাঠানো হয়ে গেলে আমাদের কিছু করার নেই।”
এ ব্যাপারে বিজিএমইএ এখন পর্যন্ত কোন ক্রেতা দেশের থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অভিযোগ পায়নি।
এ ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কোন প্রভাব ফেলবে না বলে তিনি মনে করেন।
তবে তার মতে, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ঝুঁকির আশঙ্কা থাকা এসব পণ্যের প্রস্ততকারক হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসায় অকারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
যদিও বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রায়শই নানান দেশের পণ্যের ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। এতে ওই শিল্পে বড় ধরনের কোন প্রভাব পড়ার নজির নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বিবিসি বাংলা