আন্দামান-নিকোবরের অধীন দ্বীপ ‘নর্থ সেন্টিনেল’। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দ্বীপটিতে থমকে গিয়েছে সময়। আধুনিক সভ্য সমাজের লেশমাত্র নেই সেখানে। আধুনিক মানুষ তাদের কাছে চরম শত্রু! মনে পড়ে, ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিক জন অ্যালেন চাউ সেখানে গিয়ে কীভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন?
বাইরের পৃথিবীর সামান্যতম কৌতূহলও তারা মেটাতে রাজি নয়। এই পৃথিবীতে তাদের মতো উপজাতি সম্ভবত একটিও নেই, আধুনিক পৃথিবীর জলছাপের আঁচটুকুও যাদের মধ্যে পড়েনি। তাদের সময় আটকে রয়েছে ৬০ হাজার বছর আগের পৃথিবীতে! এই দীর্ঘ সময়ে তারা একই রকম রয়েছে। প্রায়-উলঙ্গ। আগুনের ব্যবহারটুকুও জানা নেই। মেরেকেটে চার শতাধিক (কারও মতে এতো নয়, খুব বেশি ২০০) মানুষ থাকে সেখানে। এর বেশি কিছুই প্রায় জানা যায় না সেন্টিনেলিজদের নিয়ে।
১২৯৬ সালে মার্কো পোলোর লেখায় উল্লেখ মেলে সেন্টিনেলিজদের! তিনি লিখেছিলেন, এই উপজাতির মানুষরা নরখাদক। এদের চোখ লাল, তীক্ষ্ণ দাঁত। দ্বীপের বাসিন্দা নয়, এমন কাউকে দেখলেই এরা আক্রমণ করে। এবং মেরে ফেলে। যদিও ঐতিহাসিকদের মতে, মার্কো পোলো আদৌ আন্দামানে আসেননি। সম্ভবত কারও মুখে তিনি এই বিষয়ে শুনেছিলেন।
১৮৮০ সালে ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ এম ভি পোর্টম্যানের নেতৃত্বে একটি দল সেখানে গিয়েছিল। এক প্রৌঢ় দম্পতি ও চারটি শিশুকে তুলে আনে তারা। উদ্দেশ্য, এদের খুঁটিয়ে দেখা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই মানুষেরা কেউই বেশিদিন বাঁচেনি। সম্ভবত, এই বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি সেন্টিনেলিজরা। আধুনিক মানুষের প্রতি অবিশ্বাস ও ক্ষোভ তাদের বাড়তেই থাকে।
একমাত্র ত্রিলোকনাথ পণ্ডিত ছাড়া আর কারো সঙ্গে তাদের ‘ভাব’ হয়নি। গত শতকের ছয়ের দশক থেকে ভারত সরকার তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে গেলেও সাময়িক সাফল্য যা এসেছিল, তা ১৯৯১ সালে। কিন্তু ওই নৃতত্ত্ববিদের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ হলেও বাকি কারওকে এপর্যন্ত সেন্টিনেলিজরা মেনে নেয়নি।
সমুদ্রের বুকে এক নির্জন কোণে অবস্থিত নর্থ সেন্টিনেল। ভৌগোলিক কারণে মেলা ‘নির্জনতা’র আড়ালে নিজেদের জন্য একটি নিভৃত কোণ বেছে সভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিন গুজরান তাদের। আদিম মানুষের মতোই শিকারই এদের জীবিকা। নৃতত্ত্ববিদরা আকাশপথে বা সমুদ্রে নিরাপদ দূরত্ব থেকে যতটুকু দেখতে পেয়েছেন, তা থেকেই এই সব তথ্য মিলেছে। কাছে গেলে মৃত্যু অবধারিত।
এই লেখার শুরুতে জন অ্যালেন চাউয়ের কথা বলা হয়েছিল। তার পরিণতি কী হয়েছিল ভাবলে আজও শিউরে ওঠে আধুনিক বিশ্ব। ২৬ বছরের মার্কিন মিশনারি অ্যালেন সেখানে যেতে গেলে তাকে হত্যা করে সেন্টিনেলিজরা। তারপর কবরও দিয়ে দেওয়া হয় দ্বীপেই। স্বাভাবিক ভাবেই এমন এক খবর হয়ে ওঠে ‘পাঞ্চলাইন’।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, কেন ওই দ্বীপে গিয়েছিলেন অ্যালেন? জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই ভারত সরকার নর্থ সেন্টিনেল ও তার চারপাশের ৩ নটিক্যাল মাইল এলাকায় প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু ওই অস্ট্রেলীয় যুবক সেখানে তাও গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য একটাই। ওখানকার অধিবাসীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা। প্রাথমিক ভাবে কিন্তু তাকে মেরে ফেলতে চায়নি সেন্টিনেলিজরা। প্রথম দু’টি প্রচেষ্টায় তারা তির ছুঁড়ে বাধা দেয়। পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়, তিনি যেন ওদিকে না যান। এরপরই অ্যালেন এগিয়ে যান। তৃতীয় বারের প্রচেষ্টার সময়ই প্রাণ খোয়াতে হয় তাকে।
আর এখানে এসেই মনে পড়ে সত্যজিতের ছবির সেই সংলাপ। যেখানে মনমোহন গুলিয়ে দিয়েছিলেন তথাকথিত ‘সভ্য’ ও ‘অসভ্যে’র তফাত। কারা সভ্য, কারাই বা অসভ্য সেই প্রশ্নে আঙুল তুলেছিলেন আধুনিক বিশ্বের একপেশে চিন্তাধারার দিকে। সেন্টিনেল দ্বীপের বাসিন্দারা প্রথম থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কোনোভাবেই চায় না, আধুনিক মানুষের সঙ্গে মিশতে। তারা এই দ্বীপ ছেড়ে যাবে না। এখানে কাউকে আসতেও দেবে না। কিন্তু ‘সভ্য’ মানুষের তাতেই যেন আপত্তি। তাই বারবার তাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা। অথচ সভ্যতার অন্যতম শর্তই তো, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ভাবাবেগ তথা চিন্তার স্বাধীনতাকে মর্যাদা দেওয়া। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে আধুনিক বিশ্বের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা সেন্টিনেলিজদের ‘ইমিউনিটি’ও খুব দুর্বল। ফলে আচমকাই কোনও ‘সভ্য’ মানুষ সেখানে গেলে তার শরীর থেকে সাধারণ সর্দি বা জ্বরের ভাইরাসও দ্রুত নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে ওই উপজাতির মানুষদের।
২০০৪ সালে সুনামির সময় ভারত সরকার তাদের ত্রাণ দিতে চাইলেও সাহায্যকারীদের তির ছুঁড়ে দূরে যেতে ইশারা করেছিল সেন্টিনেলিজদের একটি দল। যা বুঝিয়ে দিয়েছিল, একাই থাকতে চায় এই ‘আদিম’ মানুষরা। সভ্যতা কি এইটুকুও বরদাস্ত করতে পারে না? এখানে এসেই মনে পড়ে মনমোহনকে। সেন্টিনেলিজদের ‘অসভ্য’ বলার সময় আয়নাটাও বোধহয় একবার দেখে নেয়া দরকার।