শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:২৪ অপরাহ্ন

মতিঝিলের বুকে ফের শোভা পাবে ঝিল

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৩

রাজধানীর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের বিস্তর এলাকাজুড়ে এক সময় থই থই টলটলে জলের ঝিল ছিল। মোগল আমলের সেই ঝিল আর নেই। দখলদারদের আগ্রাসনে চারপাশ ছোট হতে হতে এখন একটি কূপে পরিণত হয়েছে, রয়ে গেছে শুধু নাম। ব্যাংকপাড়া হিসেবে পরিচিত এ এলাকার পুরনো সেই রূপ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ‘রাজউক মতিঝিল পার্ক’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এর মাধ্যমে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের পেছনে করা হবে ঝিল, সারি সারি বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে ফিরে আসবে সবুজের সমারোহ, শিশুদের জন্য থাকবে পার্ক, আটতলাবিশিষ্ট ব্যবস্থাপনা ভবনও থাকবে।

প্রায় ১১ দশমিক ৮৮ একর জায়গাজুড়ে নেওয়া এ প্রকল্পের ৯ একরজুড়েই থাকবে লেক। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে ১১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি।

সূত্রের খবর, আগামী তিন মাসের মধ্যে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও পূর্ণাঙ্গ নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ হবে। চলতি বছরই এর কাজ শুরুর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে রাজউক। সব ঠিক থাকলে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে মনোমুগ্ধকর রূপে ধরা দেবে মতিঝিল। কিন্তু সবকিছুর আগে জায়গাটি অবৈধ দখলদারদের কব্জা থেকে মুক্ত করতে হবে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এলাকাটির অনেক ভবনই ঝিল দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে এ জায়গা মুক্ত করা মোটেও সহজ হবে না। কারণ দখলদারির তালিকায় রয়েছে বড় ক্লাব, ধর্মগুরু, স্থানীয় নেতাসহ প্রভাবশালী অনেকেই।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কূপের মতো ছোট হয়ে যাওয়া ঝিলের ভেতরে ও প্রবেশপথে রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি টানানো। সেখানে উল্লেখ রয়েছে ‘(বীরপ্রতীক) জাকির হোসেনের পরিবারের পক্ষ থেকে’। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, তারা এ জমির মালিক। ফরিদ হোসেন, মৃত আবিদ হোসেন, মৃত এমদাদ হোসেন ও কামরুন নেসা (কাকন) এবং আঞ্জুমান নেসা (লিগি), পিতা মৃত আব্দুল করীম খাঁন। সাইনবোর্ডে বীরপ্রতীক জাকির হোসেনের পরিবার বলা হলেও কোথাও তার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। বলা হয়েছে ৩২নং আরকে মিশন রোড ঢাকা, এই জমির ওপর বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা রায় ও ডিগ্রি রয়েছে।

একইভাবে হাইকোর্ট থেকে ১৪৩/৯নং দক্ষিণ কমলাপুর হোল্ডিংস্থ ‘বাবে মদীনা’ ও ১/২/ইনং দক্ষিণ কমলাপুর হোল্ডিংস্থ ‘বাবে মদীনা’ কমপ্লেক্স দেওয়ানবাগ শরিফের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) রাজউক, সিটি করপোরেশন কর্তৃক গৃহীত কালভার্ট রোডটি বেআইনিভাবে ৬০ ফুট প্রশস্ত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে রিট পিটিশন নং ৪৭৯০/২০০৬ করার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতিগণ রাজউকের বিরুদ্ধে এক নিষেধাজ্ঞাসহ রুল জারি করেছেন। জানা গেছে, জমির ভোগদখলকারীরা অনেক সময় হাইকোর্টে গিয়ে নিজেদের পক্ষের কাগজ দেখিয়ে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার জন্য মামলা করে। তখন হাইকোর্ট থেকে বিবাদীকে সেখানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয়।

এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের মামলা সাধারণত কোর্ট থেকে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসা হয়। এখন যে সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান জায়গার মালিক, তারা কোর্টে গিয়ে কাগজ দাখিল করলে কোর্ট কাগজপত্র দেখে যিনি মালিক তার পক্ষেই রায় দেবে। সেক্ষেত্রে রাজউক যদি দেখাতে পারে, তা হলে ওই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে বা পূর্বপাশে দেওয়ানবাগী এবং অসংখ্য অটোমোবাইলসের দোকান রয়েছে। হারুন অটোমোবাইলস ওয়ার্কশপ, বিএম মোটরস, ফরিদ অটোমোবাইলস, মেসার্স সিহাব অটো মোবাইল, মেসার্স হৃদয় অটোমোবাইলসসহ অসংখ্য অটোমোবাইলসের দোকান রয়েছে।

হারুন অটোমোবাইলসের মালিক মো. হারুন আমাদের সময়কে বলেন, আমি ভাড়া দিই ব্রাদার্স ক্লাবকে। আমার জানামতে, আরও কয়েকটি দোকান ব্রাদার্স ক্লাবের ভাড়ায় চলে।

সিহাব অটোবাইলসের তোফায়েল জানান, তিনি জনৈক নাসিরের কাছে দোকানের ভাড়া দেন। তিনি বলেন, এগুলো আমরা ভাড়া নিয়েছি নাসির ভাইয়ের কাছ থেকে। আমাদের দায়িত্বে আছে নাসির ভাই। এখানে তিনিই সব করেন। ওনার কাছেই আমরা আমাদের সুযোগ-সুবিধার কথা বলি। তিনিই সব ব্যবস্থা করে দেন।

এ ছাড়া বিদ্যমান জলাশয়ের দক্ষিণ দিকে অসংখ্য অটোমোবাইলস আর উত্তর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন। পশ্চিমে পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে সুলতানা বিল্ডিং। হাজি সুলতান আহমেদ চৌধুরী এ ভবনের মালিক। পাশেই রয়েছে জীবন বীমা করপোরেশনের করপোরেট অফিস।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজউক উদ্যোগী হলে আর সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অবৈধভাবে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। যেহেতু জায়গার প্রকৃত মালিক রাজউক, তাই কোর্টে প্রয়োজনীয় কাগজ দাখিল করলে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা রাজউকের জন্য সহজ হয়ে যাবে।

রাজউক মতিঝিল পার্কে যা থাকবে

১১ দশমিক ৮৮ একর জায়গার মধ্যে ৯ একর আয়তনের লেক উন্নয়ন করা হবে, যা প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি টাকা। তা ছাড়া ১২ মিটার বা ৪০ ফুট প্রশস্ত ১ দশমিক ১ কিলোমিটার সড়ক ও সেতু নির্মাণ করা হবে, তাতে ব্যয় ধরা হবে ৬০ কোটি টাকা। ২ দশমিক ৫ মিটার বা ৮ ফুট প্রশস্ত ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি। শিশুদের জন্য খেলার পার্ক নির্মাণ করা হবে, যার আয়তন ৬৫০০ বর্গ মিটার। এই কাজে ব্যয় হবে ৫ কোটি। এ ছাড়া ৮ তলাবিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি। পুরো প্রকল্প এলাকায় বৃক্ষরোপণ ও ল্যান্ডস্কেপিংয়ে খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি টাকা।

পার্কটি ব্যবস্থাপনার জন্য ৮ তলাবিশিষ্ট একটি বহুতল ভবনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ভবনের নিচতলায় থাকবে পার্কিং, দ্বিতীয় তলায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি, তৃতীয় তলায় মহিলাদের জন্য ইয়োগা ও ফিটনেস সেন্টার, চতুর্থ তলায় শিশুদের জন্য সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র, পঞ্চম তলায় মহিলাদের জন্য সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র, ষষ্ঠ তলায় সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র/গ্যালারি, সপ্তম তলায় ব্যবস্থাপনা অফিস, অষ্টম তলায় ফুড কোর্ট নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে রাজউক।

রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক আমাদের সময়কে বলেন, এ স্থানে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের আবাসন গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছিল; কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন- মতিঝিলের ঝিল ফেরাতে হবে। তিনি জানান, প্রকল্পের স্থান বা জমি ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে।

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, মতিঝিল এখন কংক্রিটের জঞ্জাল। বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে অবশ্য এখনো ছোট একটি জলাশয় রয়েছে। রাজউক যদি মতিঝিল পার্কটি করতে পারে, তা হলে এই এলাকায় বিভিন্ন কাজে আসা মানুষের অবকাশ যাপনের জন্য একটি ভালো মানের বিনোদনকেন্দ্র হবে। শুধু বিনোদনকেন্দ্র নয়, এ এলাকায় সবুজায়ন হলে উষ্ণতাও কমে আসবে।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে এক সভায় তার কাছে মতিঝিলে পার্কের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন রাজউক চেয়ারম্যান। এর পর নকশা ও প্রাক্কলন ব্যয় নির্ধারণ করতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য ২৩ মার্চ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় রাজউক।

মোগল আমলে মতিঝিল এলাকাটি মির্জা মোহাম্মদের মহল হিসেবে গণ্য হতো, যার মধ্যে ছিল একটি পুকুর। শুরুতে সুকাকু মহলের পুকুর হিসেবে খ্যাত হলেও পরে এই পুকুরটি মতিঝিল নামে পরিচিতি পায় এবং একই নামে নামকরণ করা হয় এলাকাটির।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com