মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫৮ অপরাহ্ন
Uncategorized

এক বছরে শতাধিক বাংলাদেশিকে জোর করে ফেরত পাঠালো জার্মানি

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০২২

আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া বাংলাদেশিদের একের পর এক ফেরত পাঠাচ্ছে জার্মানি৷ দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো বাংলাদেশির সংখ্যা অন্তত ১১৯ জন৷ আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হওয়ায় স্বেচ্ছায় ফেরার সুযোগ নিয়েছেন আরো অনেকে৷

সাত বছর কাটানোর পর গত সেপ্টেম্বরে সবুজ (ছদ্মনাম) জানতে পারেন তার আর জার্মানি থাকা সম্ভব হচ্ছে না৷ দেশটিতে থাকতে যা যা করণীয় তার সবই করেছেন তিনি৷ বৈধভাবে বসবাসের অনুমতির জন্য আইনি লড়াই চালিয়েছেন, চাকরি করে সরকারকে কর দিয়েছেন, ভাষা শিখেছেন, পেশাগত দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন৷ তখনই পেলেন দুঃসংবাদটি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাকে জানানো হয়েছিল যে আমি ত্রিশ মাসের ভিসা পাব যদি জার্মান ভাষা দক্ষতার এ-টু সনদ দিতে পারি৷ করোনার পর ভাষা শিক্ষার ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়৷ পরে ক্লাস শুরু হলে আমি পরীক্ষায় পাস করি এবং এ-টু জমা দেই৷ সেসময় আমাকে ওরা বলেনি, কিন্তু পরে জানিয়েছে, ‘তুমি দেরিতে জমা দিয়েছ, এ কারণে তোমার আবেদন গৃহীত হয়নি, তোমাকে এখন দেশে ফিরতে হবে’৷’’

মৌলভিবাজারের কমলগঞ্জের এই বাসিন্দা ২০১৫ সালে কাতার থেকে জার্মানি আসেন৷ এক বছর পরই তার আশ্রয় আবেদন বাতিল করে দেশটি৷ ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে প্রত্যাখ্যাত হয় আপিল আবেদনও৷ ‘‘জার্মানিতে সাত বছর থাকাকালে অনুমতি নিয়ে সাড়ে চার বছর একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেছি৷ প্রতি মাসে বেতন থেকে জার্মান সরকারকে ৫০০ ইউরো ট্যাক্সও দিয়েছি৷ কিন্তু শুধু সার্টিফিকেট দেরিতে দেয়ার কারণেই আমার আবেদন বাতিল করা হলো৷ অক্টোবরের ১৫ বা ১৬ তারিখ ডেকে বলল, ২২ তারিখ আমাকে চলে যেতে হবে,’’ বলেন সবুজ৷

গত এক বছরে তার মতো আরো অনেক বাংলাদেশিই জার্মানি থেকে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন৷ আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়ায় নির্দেশনা মেনে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন করেছেন৷ আর যারা এই নির্দেশনা মানেননি তাদের অনেককে চার্টার্ড ফ্লাইট ভাড়া করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রহরায় জোরপূর্বক ফেরত পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ৷ ২০২১ সালে প্রত্যাবাসন করা পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস, যারা সবাই ২০১৫ সালে জার্মানিতে আসেন৷ তাদের কেউ ছিলেন ইরাকে, কেউবা দুবাইতে৷ উন্নত জীবনের আশায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনিয়মিত উপায়ে তারা ইউরোপের এই দেশটিতে পাড়ি জমান৷

আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া ২৬ বাংলাদেশিকে চার্টার্ড ফ্লাইটে সম্প্রতি ঢাকায় ফেরত পার্ঠিয়েছে বার্লিন৷
আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া ২৬ বাংলাদেশিকে চার্টার্ড ফ্লাইটে সম্প্রতি ঢাকায় ফেরত পার্ঠিয়েছে বার্লিন৷

অন্তত ১১৯ জনকে জোরপূর্বক প্রত্যাবর্তন

গত ১৮ জানুয়ারি রাতে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে জার্মানির একটি চার্টার্ড ফ্লাইট৷ যার মাধ্যমে দেশটি থেকে  গত শুক্রবার জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস সেক্রেটারি সাশা লাওফরে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে এই তথ্য নিশ্চিত করেন৷

তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যাবর্তনকারীদের জোরপূর্বক দেশত্যাগ করানোর বাধ্যবাধকতা ছিল৷ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বিমানবন্দরে নিয়ে আসে এবং ফ্লাইটেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের সঙ্গে ছিলেন৷’’

নিয়ম অনুযায়ী কারো বসবাসের অনুমতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বা আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে তিনি জার্মানি ছাড়তে বাধ্য৷ এক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউ দেশটি থেকে না গেলে পরবর্তীতে কোনো সময় না দিয়ে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে জোরপূর্বক তাকে ফেরত পাঠানো হয়৷ এই ২৬ জনের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে৷

জার্মানি থেকে জোরপূর্বক প্রত্যাবর্তনের ঘটনা অবশ্য এবারই প্রথম নয়৷ এর আগে অক্টোবরেও ৩৩ জনকে ঢাকায় ফেরত পাঠিয়েছিল বার্লিন। জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাশা বলেন, ‘‘২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে মোট ৯৩ জন বাংলাদেশি নাগরিককে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৩ জনকে ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে৷ ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি৷’’

সামনের দিনে আর কতজনকে ফেরত পাঠানো হতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে সাশা বলেন, ‘‘আগে থেকে এই তথ্য দেয়া সম্ভব নয়৷’’

তবে, চলতি মাসে ফেরত পাঠানোদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘‘আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া ৫০ থেকে ৬০ জন বাংলাদেশির ট্রাভেল পারমিট সম্প্রতি ইস্যু করেছে দূতাবাস৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ক্লিয়ারেন্স প্রতিবেদন পাওয়ার পরে আমরা তাদের ট্রাভেল পারমিট ইস্যু করেছি৷’’

এর আগে গত অক্টোবরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো ‘আট শতাধিক বাংলাদেশিকে জার্মানি থেকে ঢাকায় ফেরত পাঠাচ্ছে বলে’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ তখন  এদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে জার্মানি ছেড়ে চলে গেছেন৷ ফলে ফেরত পাঠানোর প্রকৃত সংখ্যাটি আরো কম হবে৷

স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনে সহায়তা

গত এক বছরে আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া আরো অনেকে জার্মান কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে ফিরে এসেছেন৷ তাদেরই একজন মনসুর (ছদ্মনাম)৷ ২০১৩ সালে ইরাকে যান ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার এই বাসিন্দা৷ কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি ভালো না থাকায় ইউরোপ পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি৷ কুর্দিস্তান, তুরস্ক, গ্রিস, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, অস্ট্রিয়া হয়ে ২০১৫ সালে পৌঁছান জার্মানিতে৷ ২০২১ সালে তার আশ্রয় আবেদন সম্পূর্ণ বাতিল করে দেশটি৷ গত ২৪ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরতে বাধ্য হন তিনি৷

‘‘আমাকে বলা হয়েছে নিজের থেকে না ফিরলে জোর করে ফেরত পাঠানো হবে৷ আমি এজন্য আইওএম এর সহায়তায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেই,’’ বলেন তিনি৷

আশ্রয়প্রার্থীদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তনে উৎসাহ দিতে আরইএজি/জিএরআপি নামে জার্মানির সরকারের একটি প্রকল্প রয়েছে৷ এর অধীনেই আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম প্রত্যাবর্তনকারীদের নানাভাবে সহযোগিতা করে৷ ফ্লাইট টিকেট, যাত্রাকালীন খরচ হিসেবে ২০০ ইউরো, এমনকি এককালীন নগদ এক হাজার ইউরো অর্থ সহায়তাও বুঝে পান তারা৷ মনসুরসহ স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়া আরো কয়েকজনও এই সহায়তাগুলো পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ইনফোমাইগ্রেন্টসকে৷ এককালীন টাকা তারা বুঝে পেয়েছেন ফ্লাইটে ওঠার আগে৷ তবে যাদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো হয় এই সুবিধাগুলো পান না তারা৷

চার বছরে ফেরত ৪৫০ অনিয়মিত অভিবাসী

জোরপূর্বক বা স্বেচ্ছায় যেভাবেই আসেন না কেন প্রত্যাবাসনকারীরা বাংলাদেশে নামার পর দুইটি প্রকল্পের মাধ্যমে সহায়তা পেয়ে থাকেন, যা থেকে ফেরত আসার মোট সংখ্যাটিও জানা যায়৷ এরমধ্যে ১৬টি ইইউ দেশের অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রকল্প ইউরোপীয় রিটার্ন অ্যান্ড রিইন্টিগ্রেশন নেটওয়ার্ক বা ইরিন৷ অন্যটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে আইওএম পরিচালিত ‘প্রত্যাশা’৷

দুইটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গেই যুক্ত বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক৷ ইরিন প্রকল্পের অধীনে গত বছর জার্মানি থেকে ফিরে আসা ২৯ জনকে সহায়তা দিয়েছে তারা৷ অন্যদিকে, প্রত্যাশার অধীনে সহায়তা পেয়েছেন ১৬৮ জন৷ অর্থাৎ, সব মিলিয়ে জার্মানি থেকে ফিরে আসা প্রায় ২০০ জন গত বছর এই দুই প্রকল্পের সহায়তা নিয়েছেন৷ গত চার বছরে এই সংখ্যাটি প্রায় ৪৫০৷ এরা সবাই ২০১৫ সালের পর ফেরত এসেছেন৷

যোগাযোগ করা হলে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগামের প্রধান শরিফুল হাসান ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে আনডকুমেন্টেড বাংলাদেশিদের ফেরত আনার জন্য৷ এর মানে বাংলাদেশ চায় না অনিয়মিত পন্থায় লোক বিদেশ যাক৷’’

শরিফুল জানান, গত কয়েকবছরে ইউরোপ থেকে ফেরত আসা সবচেয়ে বেশি লোক তারা পেয়েছেন ইটালি, গ্রিস ও জার্মানি থেকে৷ ‘‘যারা ফেরত এসেছেন তাদেরকে বিমানবন্দরে জরুরি সহায়তা, কাউন্সেলিং ও পরে অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া হয় যাতে তারা ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারেন৷ পাশাপাশি এইভাবে ঝুঁকি নিয়ে যেন লোকজন ইউরোপে না যায় সেজন্য সারাদেশে আমরা সচেতনতা তৈরির কাজ করছি৷ আসলে দেশে বিদেশে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সংকটের সমাধান করতে হবে,’’ বলেন তিনি৷

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com