দুটি ঋণপত্র আর ১৮৪টি ভুয়া চালান বানিয়ে মাত্র তিন বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। এই টাকা পাচারের জন্য সাইফুল আলম মাসুদের প্রতিষ্ঠানটি পদে পদে নিয়েছে জালিয়াতির আশ্রয়। সবই ভুয়া জেনেও টাকাপাচারের পুরো বিষয়টিতে সরাসরি সহায়তা দিয়েছেন রূপালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতাচ্যূত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সহায়তা ছাড়া এমন জোচ্চুরি কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলমের গড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র এসএস পাওয়ারের মাধ্যমে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিপুল অংকের এই টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঋণপত্র বা এলসির আড়ালে টাকাপাচারের ঘটনা গত ১৫ বছর ধরে ঘটলেও ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে প্রথমবারের মতো হাতেনাতে এর প্রমাণ মিলেছে।
প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা খরচ দেখিয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারায় নির্মাণ করা হয় এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট। এর ৭০ শতাংশ মালিকানা বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপের এবং বাকি ৩০ শতাংশ চীনা কোম্পানি সেপকোর।
অনুসন্ধানে উদঘাটিত হয়, সরকারের ‘শুল্কমুক্ত সুবিধা’র আওতায় দুটি ঋণপত্রই (এলসি) খোলা হয়েছিল বাঁশখালীতে গড়া এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যেমন বয়লার স্ট্রাকচার, জেনারেটর, ট্রান্সফরমার, স্টিল স্ট্রাকচার এবং রিহিটার সিস্টেম আমদানি করার জন্য। কিন্তু এগুলোর কেনার নাম দিয়ে পুরো টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হলেও এর একটি যন্ত্রপাতিও ওই দুটি এলসির বিপরীতে দেশে আসেনি।
ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুটি ঋণপত্রই (এলসি) খোলা হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকে। সার্ভারে ব্যাংকটির আপলোড করা ভুয়া চালান দেখেও বাংলাদেশ ব্যাংক পুরো টাকাই অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে চীনা কোম্পানি সেপকোর একাউন্টে।
দেখা গেছে, টাকাপাচারের জন্য এসএস পাওয়ারের নামে এস আলম যেসব চালান রূপালী ব্যাংকে দিয়েছে, তার সবই ছিল ভুয়া। এর মধ্যে যেমন রয়েছে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানের পুরনো চালান, তেমনি আবার ২০২৫ সালের ২৯ নভেম্বরের আগাম তারিখ দিয়েও চালান বানানো হয়েছে। ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তারাও এই জোচ্চুরির বিষয়টি জানতেন। ১৮৪টি ভুয়া চালানের মধ্যে ৮৮টি আবার ভিন্ন ভিন্ন ৫০টি কোম্পানির, যেগুলোর সঙ্গে এসএস পাওয়ার ও চীনা কোম্পানি সেপকোর কোনো সম্পর্ক নেই। এসএস পাওয়ারের কিছু চালান থাকলেও সেগুলোর সঙ্গে ওই দুটি ঋণপত্রের (এলসি) কোনো সম্পর্ক নেই।
রূপালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার মহাব্যবস্থাপক আবু নাসের মোহাম্মদ মাসুদ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘এসএস পাওয়ারের নামে খোলা দুটি এলসির মোট মূল্য ছিল ৯১৪ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৮১৫.৭৮ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা) পরিশোধ করা হয়েছে।’
২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের নামে এস আলম ঢাকায় রূপালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় প্রথম ঋণপত্র (এলসি) খোলে ১২১ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। ০০০০০২৬৩১৯১৫০০০৫ নম্বরের সেই এলসির বিপরীতে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৮৭৩ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪ কোটি টাকা) চীনা কোম্পানি বরাবর পরিশোধ করে প্রথম চালানটি (নম্বর ৮৭৩৬৭০) বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে রেকর্ড করা হয় ২০১৯ সালের ২৭ মে। অন্যদিকে ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৫৬৯ ডলারের (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬ কোটি টাকা) সর্বশেষ চালানটি রেকর্ড করা হয়েছে ২০২৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। এর ভেতরেই এস আলমের এসএস পাওয়ারের চীনা সহযোগী সেপকো ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশনের একাউন্টে পৌঁছে যায় আরও ১২ কোটি ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪৩০ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যা এক হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। প্রথম এই এলসির জন্য মোট ৫৯টি ভুয়া চালান বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে আপলোড করা হয়।
ঠিক দুই বছর পর, ২০২১ সালের ৩০ মে রূপালী একই শাখায় খোলা হয় দ্বিতীয় ঋণপত্র (এলসি)। ০০০০০২৬৩২১১৫০০৩৮ নম্বরের সেই এলসির পরিমাণ ছিল ৭৯২.৪০ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যা ছিল প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। দ্বিতীয় এই এলসির জন্য মোট ১২৫টি ভুয়া চালান বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে আপলোড করা হয়।
এরপর শ্রেফ কিছু ভুয়া ‘বিল অব এন্ট্রি’ দেখিয়ে ২০২১ সালের ১৫ জুন থেকে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ভেতরে এস আলম বিদেশে সরিয়ে নেয় ৬৯৮.৩৩ মিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা।
দুটি এলসির প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার (৯১৪ মিলিয়ন ডলার) মধ্যে ১ হাজার কোটি টাকার মতো (৯৯.৫৮ মিলিয়ন ডলার) এখনও অবশ্য ‘খরচ’ হয়নি।
যখন কোনো আমদানি ও রপ্তানির তথ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সার্ভারে আপলোড করা হয়, তখন সেই তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে যুক্ত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে আমদানি না হওয়ায় এনবিআরও কোনো আমদানি তথ্য আপলোড করেনি। কিন্তু এরপরও বিস্ময়করভাবে এস আলমের ভুয়া ওই ১৮৪টি চালান বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে ঢুকে যায়। অনুসন্ধানে ডেইলি স্টার জেনেছে, চীনা প্রতিষ্ঠানটির একাউন্টে ডলার পাঠানোর জন্য ১৮৪টি ভুয়া চালানের সবগুলোরই তথ্য রূপালী ব্যাংক থেকেই আপলোড হয়েছে। ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তারা অর্থপাচারের এই ঘটনায় জড়িত না থাকলে এই কাজ কোনোভাবেই সম্ভব নয়।