রাষ্ট্র ও সমাজ সব ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা হয়ে উঠছে। তাদের তথাকথিত কমিউনিটি গাইডলাইনের দোহাই দিয়ে প্রয়োজনীয় ও যৌক্তিক কনটেন্ট মুছে ফেলা হচ্ছে। ব্যবসার খাতিরে এই প্ল্যাটফর্মগুলো কনটেন্ট সেন্সরের পাশাপাশি নিপীড়ক সরকারের সহযোগী হয়ে উঠছে। সরকারের দাবি মেনে নিয়মিত ভিন্ন মতাবলম্বী ও সমালোচকদের আইডি ও কনটেন্ট সরকারের কাছে সরবরাহ করছে তারা।
এবার দেখা যাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়া শিক্ষাবিদ গবেষকদের কাজেও হস্তক্ষেপ শুরু করেছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃপক্ষের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে ফেসবুক। হার্ভার্ডের সাবেক গবেষক জোয়ান ডোনোভান অভিযোগ করেছেন, ফেসবুকের অনুবাদ বন্ধের হুমকি পেয়ে তাঁর চাকরিই খেয়ে দেওয়া হয়েছে!
একটি গবেষণাকে কেন্দ্র করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ডোনোভানকে চাকরিচ্যুত করেছে। ওই গবেষকের সঙ্গে হার্ভার্ডের বিরোধটি স্পষ্টত একাডেমিক স্বাধীনতা, সোশ্যাল মিডিয়া এবং গবেষণার ওপর করপোরেট প্রভাবের একটি বৈশ্বিক বাস্তব দৃষ্টান্ত।
২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর একটি জুম মিটিংয়ে নিজের গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনের ডাক পান ডোনোভান। তিনি তখন হার্ভার্ডে, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ভুয়া তথ্য বিষয়ক গবেষণা পরিচালক। এটি হার্ভার্ডের জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টের অধীন ছিল। বৈঠকটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধনী দাতাদের সঙ্গে, যাদের বলা হয় ডিনস কাউন্সিল।
ডোনোভান ইন্টারনেটে ভুয়া তথ্যের বিস্তার এবং আমেরিকান সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে তাঁর গবেষণার বিষয়ে দাতাদের ব্রিফ করেন। এই জুম মিটিংয়ের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মেটার (তৎকালীন ফেসবুক) একজন সাবেক কর্মচারী ফ্রান্সেস হাউগেন টেক জায়ান্টটির হাজার হাজার পৃষ্ঠার অভ্যন্তরীণ নথি ফাঁস করে দেন।
হাউগেন সে বছরের ৫ অক্টোবর মার্কিন কংগ্রেসের সামনে এ নিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, এই নথিগুলোতে স্পষ্ট যে, ফেসবুকের পরিষেবাগুলো সমাজের ক্ষতি করছে, ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে এবং কিশোর–কিশোরীদের ক্ষতি করছে—এটি ফেসবুক কর্তৃপক্ষও জানে। কিন্তু তারা সামাজিক সুরক্ষা উপেক্ষা করে পয়সা কামানোকেই বেছে নিয়েছে।
ডোনোভান হার্ভার্ডের দাতাদের সামনে আরেকটি বোমা ফাটান: তিনি তাঁদের বলেন, তাঁর কাছেও এমন নথিপত্রের ভান্ডার রয়েছেন। বিপুল পরিমাণ নথি পেয়েছেন, তিনি যাকে ‘ইন্টারনেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি’ বলে মনে করেন। হাউগেনের মতো তিনিও দাবি করেন, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের পরিষেবার ক্ষতি সম্পর্কে জানে, কিন্তু কিছুই করে না।
ডোনোভানের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ফেসবুক নিজেই খারাপ লোকদের শিকার, নতুন প্রযুক্তিকে এসব মানুষ অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করে—এটা যেমন সত্য, আবার ফেসবুক নিজেই এমন সিস্টেম ডিজাইন করেছে যা সবচেয়ে উত্তেজক বিষয়বস্তুকে উৎসাহিত করে।
তিনি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সমস্যাটা হলো, সোশ্যাল মিডিয়া নিজেই খারাপ লোকদের যেচে সুবিধা দেয়, বিশেষত নতুন এবং আপত্তিকর বিষয়বস্তু—যেটি ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে— সেটিতেই তারা গুরুত্ব দেয়। এখানে যা ভুল হচ্ছে তা ফেসবুকের বাইরের বিশ্বের বিষয় নয়, বরং এটি রয়েছে কোম্পানির অ্যালগরিদমের ভেতরেই।’
ডোনোভান যখন জুম কলে তাঁর গবেষণার ফলাফলগুলো ব্যাখ্যা করা শেষ করেন, তখন জুম মিটিংয়ে থাকা একজন হাত তোলেন। তিনি ছিলেন ইলিয়ট শ্রেজ। তিনি হার্ভার্ডের ডিনস কাউন্সিলের দাতা গোষ্ঠীর সদস্য এবং ফেসবুকের গ্লোবাল কমিউনিকেশনস এবং পাবলিক পলিসির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট।
শ্রেজ এই গবেষণার ফলাফলের তীব্র বিরোধিতা করেন। বাগ্বিতণ্ডা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, মিটিংটি সেখানেই শেষ হয়ে যায়। বিষয়টি পরে তাঁর সুপারভাইজারকে জানিয়েছিলেন ডোনোভান। সুপারভাইজার জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, যদি তিনি পাগল না হয়ে থাকেন তাহলে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত ছিল।’
শ্রেজ অবশ্য এ ব্যাপারে সিএনবিসির কাছে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। ফেসবুকও অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এর আগে ফেসবুকের গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড কমিউনিকেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিক ক্লেগ (যুক্তরাজ্যের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী) ফেসবুকের বিরুদ্ধে ওঠার এ ধরনের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে, পছন্দমতো কিছু তথ্য–উপাত্ত নিয়ে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়।
ডোনোভান বলেন, এ ঘটনার পর থেকে হার্ভার্ডের ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে তেমন সমর্থন পাননি। ফেসবুক গবেষণায় তিনি আর এগোতে পারেননি।
ওই বছরের নভেম্বরের শুরুতে কেনেডি স্কুলের তৎকালীন ডিন ডগলাস এলমেনডর্ফ ফেসবুকের প্রভাব নিয়ে গবেষণার বিষয়ে নানা প্রশ্ন তুলে ডোনোভানকে ই–মেইল করেন। এমনকি তিনি বলতে গেলে, গবেষণায় পাওয়া ফলাফল ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ করেন।
এমন ই–মেইল পেয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন ডোনোভান। ডিন ডগলাসের কণ্ঠে তিনি ফেসবুক নির্বাহীদের কণ্ঠেরই প্রতিধ্বনি শুনেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, ফেসবুকের মূল সংস্থা মেটার তৎকালীন প্রধান অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গের সঙ্গে ডিন এলমেনডর্ফের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে।
এলমেনডর্ফ হার্ভার্ডে স্যান্ডবার্গের স্নাতক উপদেষ্টা ছিলেন। স্যান্ডবার্গ নিজেই হার্ভার্ডের কেনেডি স্কুলের বড় দাতা। এলমেনডর্ফ ২০২২ সালের গ্রীষ্মে স্যান্ডবার্গের বিয়েতেও আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন।
ডোনোভান বলেন, ‘আমাকে প্রিন্সিপালের অফিসে ডাকা হয়েছিল এবং আমি কেন ফেসবুক নিয়ে কথা বলছি সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ডিন আমাকে কখনো টুইটার বা ইউটিউব বা গুগল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেননি। অথচ এগুলো নিয়েও তদন্ত করেছি।’
হার্ভার্ডের একজন মুখপাত্রের মাধ্যমে এলমেনডর্ফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। শেরিল স্যান্ডবার্গও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
হার্ভার্ডের কর্মকর্তারা দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, এলমেনডর্ফ এবং স্যান্ডবার্গ কখনই ডোনোভানকে নিয়ে আলোচনা করেননি।
পরের মাসে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ এবং তাঁর স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান পরিচালিত দাতব্য সংস্থা ঘোষণা দেয়: হার্ভার্ডে একটি নতুন ইনস্টিটিউট তৈরি করার জন্য ১৫ বছরের মধ্যে ৫০ কোটি ডলার দেওয়া দেবে তারা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিষয়ে জাকারবার্গের মায়ের নামে হবে ইনস্টিটিউট। জাকারবার্গ এবং প্রিসিলা দুজনেই হার্ভার্ডের প্রাক্তন।
এই সময় এ নিয়ে হার্ভার্ড ক্যাম্পাসে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। অনেক শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে করপোরেটের অনুপ্রবেশ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে হার্ভার্ডে সবচেয়ে বড় অনুদানটি এসেছিল চ্যান–জাকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ থেকে। অবশ্য এটিই তাদের প্রথম অনুদান নয়। ২০১৮ সালের উপাত্ত দেখে বোঝা যায়, ফাউন্ডেশনটি হার্ভার্ড বা এর সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোকে কোটি কোটি ডলার অনুদান দিয়েছে।
ডোনোভান বলেন, যত মাস যাচ্ছিল হার্ভার্ডে তাঁর অবস্থান ততই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল, কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে তিনি চাকরিটা ছেড়ে দেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন বিশেষভাবে ফেসবুকের দিকে মনোযোগ দিই, তখনই চাপের মুখে পড়ি।’
২০২২ সালের গ্রীষ্মে ডিন এলমেনডর্ফের সঙ্গে বৈঠকে ডোনোভানকে জানানো হয়, তাঁর প্রোগ্রামটি বন্ধ করতে হবে। এটি ছিল প্রযুক্তি এবং সামাজিক পরিবর্তন বিষয়ক গবেষণা প্রকল্প। এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের জুনে।
ডোনোভান ছিলেন হার্ভার্ডের স্টাফ। ফ্যাকাল্টি না হওয়ার অজুহাতে তাঁকে শেষ পর্যন্ত আর সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই গবেষণা প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। চাকরি হারান ডোনোভান।
ডোনোভানের চাকরি হারানোর বিস্তারিত বিবরণ গত বছরের ২৮ নভেম্বর হার্ভার্ডে পাঠায় হুইসেল ব্লোয়ার এইড। একই অলাভজনক গোষ্ঠী ২০২১ সালে ফেসবুক হুইসেল ব্লোয়ার হাউগেনের সঙ্গে কাজ করেছিল।
হুইসেলব্লোয়ার এইড ম্যাসাচুসেটসের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে ডোনোভানের অভিযোগ পাঠায়। এরপর ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনের অফিস ফর সিভিল রাইটসের কাছেও ডোনোভানের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। তবে কোনো পক্ষ থেকেই কোনো অগ্রগতি হয়নি।