সাদামাটা গৃহবধূ, সঙ্গীত শিল্পী ও স্কুল শিক্ষিকা থেকে রাজনৈতিক নেত্রী, সেখান থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে পরাজয়। এরপর সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ পেয়ে যান সিরাজগঞ্জের প্রভাবশালী নেত্রী জান্নাত আরা হেনরী। আর এই পদটি যেন আলাদীনের প্রদীপের মতো ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয় তার।
মাত্র তিন বছরেই অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যান। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে দলীয় পদ-পদবীর পাশাপাশি বাড়তে থাকেও তার সম্পদের পরিধিও।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বনে যান সিরাজগঞ্জের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর নেত্রী। নিজে সাংসদ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে স্বামী শামীম তালুকদারকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বানিয়ে আনেন। অবশ্য এ নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ তার উপর ক্ষুব্ধ হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের সদানন্দপুর গ্রামের আব্দুল হামিদ মিঞার মেয়ে জান্নাত আরা হেনরী। জেলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ ভাষা সৈনিক সাবেক গভর্নর মোতাহার হোসেন তালুকদারের ছেলে শামীম তালুকদার লাবুর সঙ্গে বিয়ের পর সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ে সঙ্গীত শিক্ষকের চাকরি করেন। পাশাপাশি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।
রাজনৈতিক পরিবারের পুত্রবধূ হওয়ার সুবাদে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন যুদ্ধে তৃণমূল ভোটে অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় হন। প্রথম হয়েছিলেন দলের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম। দুর্নীতির মামলায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় ভাগ্যের চাকা খুলে যায় হেনরীর। নৌকা প্রতীকে পান রাজনীতিতে সম্পূর্ণ আনাড়ি গৃহবধূ।
ওই নির্বাচনে সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার হলেও অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করার পর জান্নাত আরা হেনরীকে করা হয় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য।
এরপরই ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে জান্নাত আরা হেনরীর সম্পদ। রিকশা থেকে এক লাফে উঠে যান ৮৭ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্লুজারে। ঢাকা ও সিরাজগঞ্জ মিলে গড়ে তোলেন কয়েকটি বাড়ি ও একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই তিনি শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারির মামলায় জড়িয়ে পড়েন জান্নাত আরা হেনরী।
এ ঘটনায় পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। অবশ্য ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওই অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পান হেনরীসহ পরিচালকগণ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা জানান, হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে দায়মুক্তির পর ধীরে ধীরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সম্পত্তি বাড়াতে থাকেন। নিজের নামে ছাড়াও স্বামী শামীম তালুকদার লাবু, মেয়ে ও বোনের নামে একের পর এক সম্পদ গড়ে তোলেন। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চেষ্টা করেও দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন তিনি।
তিনি আরও জানান, ২০২৩ সালে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর রাজনীতিতে তার প্রভাব ক্রমশই বাড়তে থাকে। অবশেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাগিয়ে এনে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। নিজে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মাথায় স্বামী শামীম তালুকদার লাবুকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে আনেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ ও গাজীপুরে হেনরীর নামে সাইনবোর্ড দেওয়া স্থাবর অনেক সম্পদ আছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার নলিছাপাড়া নামক স্থানে হেনরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ, পাশেই হেনরী ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্স টেকনোলজি, শহরের মুজিব সড়কে একটি দ্বিতল বাসভবন, পাশে আরেকটি ৬ তলা বিলাসবহুল বাড়ি, ওই বাড়ির বিপরীত পাশে ৯ তলা ভবনে রয়েছে অর্ধকোটি টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট, শহরের ফজল খান রোডে হেনরী স্কলাসটিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সদর উপজেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের গজারিয়াতে ‘হেনরী ভুবন’ নামে আধুনিকমানের বিশাল বৃদ্ধাশ্রম, তার বিপরীত পাশে ‘কিছুক্ষণ’ নামে একটি রিসোর্ট, রিসোর্টের পশ্চিম পাশে অপটিক ফাইবার কারখানা, তার পাশে গরুর খামার, উত্তর পাশে শ্বশুর মোতাহার হোসেন তালুকদারের নামে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, শহরের এসএস রোডে বোন জুবিলীর নামে ছয়তলা বাণিজ্যিক ভবন, সয়দাবাদ ইউনিয়নের সদানন্দপুরে পাঁচতলা আবাসিক ভবন, কড্ডায় নির্মাণাধীন রয়েছে পেট্রোল পাম্প, শহরের সদর পোস্ট অফিসের বিপরীতে নির্মিত হচ্ছে একটি বহুতল ভবন।
অপরদিকে গাজীপুরের শ্রীপুরে বিলাসবহুল ‘রাস রিসোর্ট’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৪টি আধুনিক কক্ষ, পাঁচটি প্রিমিয়াম বাংলো, আলাদা জায়গায় চারটি আর্কিটেকচারাল ডিলাক্স কটেজ ও আধুনিক সুইমিংপুল রয়েছে। শ্রীপুরে রয়েছে গরুর খামার। সম্প্রতি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর শিয়ালকোল ইউনিয়নের শিলন্দা গ্রামে ১০.১২ বিঘা অকৃষি জমি প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকায় কিনেছেন হেনরী।
তথ্য অনুযায়ী সিরাজগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুরে প্রায় সাড়ে ১৮শ শতাংশ কৃষি ও অকৃষি জমি রয়েছে হেনরীর। এ ছাড়াও রয়েছে ৯টি বিলাসবহুল গাড়ি। এর মধ্যে ৯৫ লাখ টাকা মূল্যের একটি প্রাডো জিপ, ১৮ ও ২৬ লাখ টাকা মূল্যের দুটি প্রাইভেট কার, ১২ লাখ টাকা মূল্যের একটি পিকআপ। আরও রয়েছে ৫টি মাইক্রোবাস। ৯টি গাড়ির মোট মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী জান্নাত আরা হেনরীর বাৎসরিক আয় দেখানো হয়, এক লাখ বাইশ হাজার টাকা। সে সময় সম্পদ দেখানো হয়েছিল প্রায় ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকার। গত ১৬ বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি ৫শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই পলাতক রয়েছেন জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবু। এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে তাদের মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। বন্ধ পাওয়া যায় জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ফোনও।