বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট মার্টিন চায়, সেন্ট মার্টিন দিয়ে তিনি ক্ষমতায় থাকতে চান না। শেখ হাসিনা এটাও বলেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, তিনি এক ঈঞ্চি জমি দিয়ে, দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে তিনি ক্ষমতায় থাকবেন না। আর এর জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, সেন্ট মার্টিন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। তিনি এটিও বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে যা বলা হচ্ছে- তা সঠিক নয়। এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠেছে আসলে কার বক্তব্য সত্যি। এই নিয়ে বিভিন্ন সামরিক নথিপত্র এবং দলিল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, সেন্ট মার্টিন নিয়ে মার্কিন আগ্রহের কথা অন্তত তিনটি দলিলে বিভিন্ন সময় এসেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে সেন্ট মার্টিন চেয়েছে- কি চায়নি সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু বঙ্গেপোসাগর অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির কৌশলগত অবস্থান জরুরি বলে একাধিক মার্কিন দলিলে মন্তব্য করা হয়েছে। বিশেষ করে সেন্ট মার্টিনে যদি সামরিক নৌঘাঁটি থাকে, সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই অঞ্চলকে নিরাপদ রাখতে সহায়তা করবে বলেও একাধিক মার্কিন দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মাটিন নিয়ে আগ্রহ ১৯৭২ সাল থেকে। সেই সমসয় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সাথে। বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি চান এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সমর্থন করবে- এমন মন্তব্য করেন। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবমুক্ত দলিলে এ তথ্য পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় ফারল্যান্ড পরবর্তীতে তারবার্তার মাধ্যমে নিশ্চিত করেন যে, সেন্ট মার্টিন বা বঙ্গপোসাগরে মার্কিন ঘাঁটি বা মার্কিন সামরিক উপস্থিতির ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার আগ্রহী নয়।
৭৫’র পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও দেখা যায়, সেন্ট মার্টিন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিকবার আগ্রহ এবং দর কষাকষি হয়েছে। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় একটি উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন সামরিক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে। ১৯৮০ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত তারা বাংলাদেশ সফর করে। এ সময় তারা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এলাকা পরিদর্শন করেন। এই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং মার্কিন সামরিক বাহিনী এখানে যৌথ মহড়া করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর কারণে এই মহড়া হয়নি।
১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ ক্ষমতা গ্রহণ করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের সময়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দলিলে সেন্ট মার্টিন নিয়ে আগ্রহের কথা প্রকাশিত হয়। উইকিলিকস-এর ফাঁস করা এক দলিলে দেখা যায়, ইরাক-কুয়েতের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উপমহাদেশে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, সে সময় ‘মার্কিন সামরিক কৌশল এবং যা করণীয়’- শীর্ষক এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপমহাদেশেও এরকম সঙ্কট এবং শঙ্কা রয়েছে। আর এ কারণেই উপমহাদেশের সামরিক ভারসাম্য অটুট রাখার জন্য বঙ্গপোসাগর এলাকায় একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা জরুরি। এই বিষয়টি নিয়ে পেন্টাগন দীর্ঘদিন কাজ করছে বলেও ওই দলিলে উল্লেখ করা হয়। এরশাদের শাসনামলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্কের উত্তরণ ঘটে এবং দুই দেশ একত্রে যৌথ মহড়ার ব্যাপারে একমত হয়। ৮৮ সালে এই সামরিক ঐক্যের অংশ হিসেবেই শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত হয় এবং ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের স্বশস্ত্র বাহিনী অংশগ্রহণ করে।
কিন্তু এরশাদের পতনের পর এ বিষয়টি আবার থিতিয়ে পড়ে। ১৯৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউ মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি’- শিরোনামে একটি গবেষণা নিবন্ধে দেখা যায়, উপমহাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থান ঠেকানোর জন্য বঙ্গপোসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তবে এখানে কোথাও সেন্ট মার্টিন দ্বীপটির কথা উল্লেখ করা হয়নি।
বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলের শুরুতেই বঙ্গপোসাগর এলাকায় একটি প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড় হয় এবং ঘুর্ণিঝড়ের সহায়তা করতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এই নিয়ে রাজনীতিক তোলপাড়ের মুখে শেষ পর্যন্ত সেই সামরিক উপস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৯/১১- এর পর অর্থাৎ টুইন টাওয়ার হামলার পর বিভিন্ন দেশে ‘স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যাসমেন্ট’ শিরোনামে এক গোপন নথি উইকিলিকস-এ ফাঁস হয়। সেই ‘স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যাসমেন্ট’ দলিলে দেখা যায়, যে জায়গাগুলোকে স্পর্শকাতর এবং যুক্তরাষ্ট্র সামরিক উপস্থিতি জরুরি বলে মন্তব্য করা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বঙ্গপোসাগর এলাকা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গপোসাগরের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলিলে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তা হলে সেন্ট মার্টিন নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনার কি কোনো দরকার আছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন, কোনো দেশই আরেকটি দেশের সামরিক উপস্থিতির জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা যে ইরাকে অবস্থান করছে, তা কি কোনো সামরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে হয়েছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে দীর্ঘদিন আফগানিস্তানে অবস্থান করেছিল- তা নিয়ে কি আগাম কোনো আলাপ-আলোচনা হয়েছিল? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অভিপ্রায়ের কথা কখনোই আলোচনা করে না, বরং অভিপ্রায় অর্জনের জন্য কৌশলগত অবস্থান নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে সেন্ট মার্টিন নিয়ে তেমনটি হচ্ছে।