সুইস ব্যাংকে জমা রাখা বাংলাদেশিদের অর্থ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ৯৪ শতাংশ অর্থ তুলে নিয়েছে বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এক লাফে এত টাকা কমে যাওয়া এবং সেই অর্থ গেলই বা কোথায়- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেইসঙ্গে দেশে অর্থ পাচারের বিষয়টিও নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
টাকা পাচার ঠেকাতে এবং পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরাতে বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা হলেও তার সুফল মেলেনি। টাকা ফেরত আনাতো দূরের কথা, পাচার রোধ করাও সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সুইস ব্যাংকের এত টাকা কোথায় গেল তা জানার আগ্রহ অনেকের। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিরা টাকা রাখেন। দেশের অর্থ পাচার করা এখন অনেকের কাছে সহজ।
শুধু সুইস ব্যাংকে নয়, চাইলেই যেকোনো দেশে টাকা নিয়ে যাওয়া যায়। বর্তমানে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও হুন্ডি পদ্ধতিতে বিশ্বের অনেক দেশেই টাকা পাচার হচ্ছে। তবে, এ বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত উল্লেখযোগ্য হারে কমার কারণ এবং কারা এই আমানত তুলে নিচ্ছে- তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। কারণ, সুইস ব্যাংকের আমানতদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম জানানো হয় না। শুধুমাত্র দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন দেশ থেকে জমা হওয়া অর্থের হিসাব তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে থাকে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধ ও ভিসা নীতি বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মার্কিন বিধিনিষেধ বা ভিসা নীতির প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী। আর মার্কিন মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত বিধিনিষেধ নীতি অনুসরণ করতে দেখা গেছে। এ কারণে অর্থ পাচারকারীরা যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলোয় বিনিয়োগ বা অর্থ গচ্ছিত রাখাকে নিরাপদ বলে মনে করছেন না।
খাতসংশ্লিষ্টদের সন্দেহ, পাচারকৃত অর্থ এখন তুরস্ক, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, সেøাভেনিয়া ইত্যাদির মতো পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে সরিয়ে আনা হচ্ছে। সরকারি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ব্যাংক খাতের নির্বাহীসহ বিভিন্ন খাতের দুর্নীতিগ্রস্তদের অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। দুবাইয়ের গোল্ড কার্ডধারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই সেখানে বিপুল অঙ্কের পুঁজি পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ সংশ্লিষ্টদের। আরেক গন্তব্য হিসেবে বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও হংকংয়ে বাংলাদেশিদের অর্থ পাচার হতে পারে বলে মনে করেন অনেকেই।
বাংলাদেশিদের আমানত কমার বিষয়টি কেউ কেউ সন্দেহের চোখে দেখলেও চলমান ডলার সংকটের কারণেও সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত কমতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, এখানে ৩টি বিষয় দেখতে হবে। এক. অনেকে ব্যক্তিগতভাবে সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে নিরাপত্তার জন্য। দুই. আমাদের অনেক ব্যাংকও সেখানে টাকা রাখে ট্রানজেকশনের জন্য। তিন হলো- যারা টাকা চুরি করে তারাও সুইস ব্যাংকে রাখছে।
এখন ৯৪ শতাংশ টাকা তুলে নিয়েছে কারা? যেসব ব্যাংক টাকা রেখেছিল তারা ডলার সংকটের কারণে হয়তো সেখান থেকে খরচ করেছে। দ্বিতীয়ত, যারা অবৈধ টাকা রেখেছে তারা হয়তো ভয় করতে পারে যেকোনো কারণে যদি কোনো সরকার পরবর্তীতে এই নামগুলো চায়- সেটার ভয়েও তারা এই টাকাটা তুলে ফেলতে পারে। কিন্তু সুইস ব্যাংকতো ৯৪ শতাংশ কারা সেটা বলেনি। সুতরাং নিশ্চিত করে এটা বলাও যায় না যে কারা এই অর্থ তুলে নিয়েছে। তারাতো নাম প্রকাশ করে না যদি সরকার না চায়। আমরা কিন্তু অনেকদিন ধরে বলে আসছি যে ভারত যেভাবে নাম প্রকাশ করে এবং সেটি বৈধ না অবৈধ সেটা তারা তদন্ত করেছে। এতে অনেক টাকা ফেরত আনা গেছে এবং অনেককে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু আমরাতো সেভাবে করিনি। সুইস ব্যাংকের টাকা কোথায় গেছে বা কারা তুলেছে সেটার তথ্য যদি চাওয়া হয় তারা দেবে। এখনতো তাদের আইনও পরিবর্তন হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, স্ইুস ব্যাংকে আগে যেসব গোপনীয়তা বা সুবিধা ছিল, সেগুলো এখন নেই। এখন সুইস ব্যাংকের চেয়ে অনেক সহজ এবং বিকল্প এসেছে। সেসব জায়গায় অতি সহজে টাকা পাচার করা যায়। বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই- এসব জায়গায় অতি সহজে এখন অর্থ পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের আর সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। হুন্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেক দেশের ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফার করা যায়। পুঁজি পাচারকারীরা সেই সুযোগ নিচ্ছে।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এ. বি. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, হতে পারে যে, মানুষজন সুইস ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে। কিন্তু কথা হলো- সুইস ব্যাংকতো কোনো খবর দেয় না, তাদের কাস্টমারদের বিষয়ে কোনো তথ্য দেয় না। সে দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে হবে যে তা বের করা যায় কিনা। তিনি বলেন, পাচারের অর্থ ফেরত আনা বা পাচার রোধ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু কিছুইতো ফেরত আসেনি। অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণায় বলেছেন কিছুই ফেরত আসেনি। কিন্তু পাচার যে হচ্ছে না এটাতো গ্রহণযোগ্য না।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। গত বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৫৩ লাখ সুইস ফ্রাঁতে। বাংলাদেশে সুইস ফ্রাঁর খুব বেশি লেনদেন হয় না। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১২১ টাকা। সেই হিসাবে ৫ কোটি ৫৩ লাখ সুইস ফ্রাঁতে দাঁড়ায় প্রায় ৬৬৯ কোটি টাকা। এসএনবি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই ২২ বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে কম অর্থ ছিল ২০০৩ সালে। ওই বছর দেশটির ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র আড়াই কোটি সুইস ফ্রাঁ। এরপর দেশটিতে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছিল ২০২১ সালে, ৮৭ কোটি সুইস ফ্রাঁর বেশি।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার রিপোর্টে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে। এসব রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের সিংহভাগই সুনির্দিষ্ট ১০ দেশে যায়। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কর কম এবং আইনের শাসন আছে- অপরাধীরা সেসব দেশকেই বেছে নিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং এবং থাইল্যান্ড। সাম্প্রতিক সময়ে পাচারের বড় অংশই দুবাইয়ে যাচ্ছে। বড় কয়েকটি গ্রুপ সেখানে অফিস খুলে টাকা পাচার করছে। এ ছাড়াও বড় অঙ্কের ঘুষ লেনদেনের জন্য দুবাই নিরাপদ।