শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১২:৩১ পূর্বাহ্ন

লুই ভিতনের আজব ট্রাঙ্ক

  • আপডেট সময় সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৪

প্যারিসে পা রাখলেই আমি অ্যাভেন্যু দ্য সঁজেলিজের প্রশস্ত রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি। এই রাস্তায় পৃথিবীর প্রায় সব দেশের, নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের দেখা মেলে। এসব মানুষ নানা ভাষায় কথা বলে। আমি মানুষ দেখি, দেখি অ্যাভেন্যুর দুই ধারে নামকরা ব্র্যান্ডের দোকানগুলো। দেখি নানা স্থাপনা। আমি এ সময়ে সময় দেখি না, সময়ের হিসাব করি না।

সঁজেলিজের ১০৩ নম্বরে এসে ধাতব রঙের পেল্লায় এক তোরঙ্গ, অর্থাৎ বাক্স দেখে চমৎকৃত হলাম। আসলে বাক্সের আদলে বিশাল এক ঝকঝকে দালান, স্থাপত্যসৌকর্যে অনন্য এক স্থাপনা। অনেক কৌতূহলী পথচারীর মতো আমিও থমকে দাঁড়ালাম, ছবি তুললাম। এটি নামকরা ব্র্যান্ড, ফ্যাশন জগতের নক্ষত্র লুই ভিতনের নতুন ঠিকানা।

লুই ভিতনকে (১৮২১-১৮৯২) আধুনিক লাগেজ বা বাক্সের জনক বললেও ভুল হবে না। প্রায় বিশ্বজুড়ে পাওয়া যায় নানা রকম বিলাসী উপকরণ। বাক্স, হাতব্যাগ, জুতা, পোশাক, ঘড়ি, রোদচশমা—এককথায় আধুনিক মানুষের জীবনধারায় যা কিছু প্রয়োজন, সবই আছে এই ব্র্যান্ডের বিপণিতে।

অথচ লুই ভিতনের অনেক দিন কেটেছে অভুক্ত, অর্ধভুক্ত আর দুর্দশায়। ১০ বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। পিতা কালক্ষেপণ না করে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎমা খুব একটা সদয় ছিলেন না। তাই এক বসন্তে আনুমানিক ১৩ বছর বয়সে লুই কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। ইচ্ছা প্যারিসে যাবেন। নিজ গ্রাম থেকে প্যারিসের দূরত্ব ৩০০ মাইল বা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। সেই সময়টা ছিল ঘোড়ায় টানা গাড়ির যুগ। তারপরও জেদি বালকটি তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলেন না। হেঁটেই দুর্গম ও বিপৎসংকুল পথে পা বাড়ালেন। পথে বিভিন্ন বাসা বাড়ি, দোকানে নানা রকম কাজ করেছেন। স্বপ্নের নগরী প্যারিসে যখন পৌঁছালেন, তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর, পথেই কেটে গেছে ৩ বছর!

প্যারিসে এসে কাজ জুটে যায় একটি বাক্স তৈরির কারখানায়। বালকের শৈল্পিক ও কারিগরি দক্ষতায় মুগ্ধ কারখানার মালিক মশিয়েঁ মারেশেল। সে সময়ে স্টিম ইঞ্জিনের বদৌলতে ভ্রমণের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। সে কারণে লুইয়ের উদ্ভাবিত টেকসই, হালকা, নিরাপদ এবং দৃষ্টিনন্দন ট্রাঙ্ক সাড়া ফেলে। তাঁর চমৎকার উদ্ভাবনী ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পড়ে প্যারিসের অভিজাত মহলে।

সঁজেলিজেতে বাক্সের আদলে বিশাল এক ঝকঝকে দালান, স্থাপত্যসৌকর্যে অনন্য এক স্থাপনা

সঁজেলিজেতে বাক্সের আদলে বিশাল এক ঝকঝকে দালান, স্থাপত্যসৌকর্যে অনন্য এক স্থাপনা। ছবি: লেখক

দেখতে দেখতে ১৬ বছর অতিক্রান্ত হয়। লুই ৩২ বছরের টগবগে যুবক। তৃতীয় নেপোলিয়ঁ তখন ‘সম্রাট’ উপাধি ধারণ করে ফ্রান্সের শীর্ষ ক্ষমতায় আসীন। সম্রাজ্ঞী ইউজেনি ডি মন্তিখো ছিলেন ভীষণ ফ্যাশনসচেতন আর ভ্রমণপ্রিয়। ভ্রমণকালে তাঁর বহুমূল্য রাজকীয় পোশাক-আশাক প্রায়ই জৌলুশ হারায়। তাই তিনি ডেকে পাঠান লুই ভিতনকে। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ভ্রমণকালীন সম্রাজ্ঞীর জন্য জুতসই বাক্স, তোরঙ্গ তৈরির। সম্রাজ্ঞীর সব মালপত্র, প্রসাধনী চমৎকারভাবে সাজিয়ে প্যাকেট করার গুরুদায়িত্বও পড়ে এই তরুণের কাঁধে। সে সময় রাজরাজড়াদের সান্নিধ্যে স্বকীয় প্রতিভার দীপ্তিতে আরও বেশি উজ্জ্বল, উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন কারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গড়ে তুললেন নিজের বিশাল ফ্যাশন সাম্রাজ্য। সেই শুরু।

আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে রাজধানীতে এসেছিল কপর্দকহীন এক ভাগ্যহত বালক। নিজের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম, ধৈর্য আর মেধা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন সীমানাবিহীন বিশাল এক ফ্যাশন সাম্রাজ্য। লুই ভিতনের সেই সাম্রাজ্য আজও দেদীপ্যমান। ফরাসিদের জীবনধারায়, শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টিতে যাঁরা স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন, তিনি তাঁদেরই একজন, ফ্যাশন জগতের আইকন।

পৃথিবীর সুন্দরতম অ্যাভেন্যু সঁজেলিজের প্রশস্ত রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে ট্রাঙ্কের আদলে বিশাল বাণিজ্যিক ভবনটি আপনাকে সে কথাই মনে করিয়ে দেবে। অবাক চোখে দেখবেন লুই ভিতনের আজব ট্রাঙ্ক।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com