ইতিহাস সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া কমলা হ্যারিস নিজেই এক ইতিহাস। তার জীবনের রয়েছে অনেক ইতিহাস, যে ইতিহাসের শুরু তার মা-বাবার প্রণয়ের মধ্য দিয়ে।
ষাটের দশকের আমেরিকা তখন উত্তাল। কালোদের অধিকার নিয়ে চলছে আন্দোলন-সমাবেশ। চলছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। নাগরিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার বিভিন্ন পক্ষ।
কাছের দেশ কিউবায় তখন চলছে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বিপ্লব। বাক্স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার মার্কিন নাগরিকরা। ব্রিটিশ উপনিবেশের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে দলে দলে অভিবাসীরা ভিড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা সোচ্চার হচ্ছেন। সেই উত্তুঙ্গ সময়ে দেখা হয় কমলার বাবা ও মায়ের।
১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বারকেলিতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লম্বা ক্ষীণ স্বাস্থ্যের পিএইচডি শিক্ষার্থী ছোট একটি জটলার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন ওই তরুণ। রুমভর্তি একদল কালো তরুণের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন তাদের দেশে ব্রিটিশ উপনিবেশের কথা। তিনি বলছিলেন, একদল ‘সাদা মানুষ’ এক শ্রেণির ‘এলিট ব্ল্যাক’তৈরির মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টি করছে।
ওই তরুণের নাম ডোনাল্ড জে হ্যারিস। তখন তার বয়স ছিল ২৪। তার বক্তৃতা শুনে সেই ছোট সমাবেশে আবির্ভাব ঘটে এক তরুণীর। শাড়ি ও স্যান্ডেল পরা সেই তরুণী একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী। তার দেশেও ছিল ব্রিটিশ শাসন। সেদিনের সমাবেশে সবার মধ্যে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম।
তার নাম শ্যামালা গোপালান। একই বছরে শ্যামালা ও হ্যারিসের জন্ম। তারা উভয়ই ব্রিটিশশাসিত দেশের নাগরিক। একজন সরকারি কর্মকর্তার মেয়ে শ্যামালার মনে আরো কৌতূহল ছিল হ্যারিসের বক্তৃতা শোনার। তিনি হ্যারিসকে বলেছিলেন, ‘আমি আরো শুনতে চাই আপনার কথা।’
সেই স্মৃতি স্মরণ করে বর্তমানে ৮২ বছর বয়সী স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রথিতযশা শিক্ষক হ্যারিস বলেন, এটা ছিল খুবই উৎসাহী করার মতো একটা ব্যাপার। কেউ একজন বিশ্বাস করছে যে সম্ভব, এটা আমাকে পুলকিত করল। পরবর্তী সভায় আবার আমাদের কথা হলো। এভাবে আমাদের কথা চলতেই থাকল। আর বাকিটা তো ইতিহাস।
ব্রিটিশ উপনিবেশভুক্ত দেশগুলোতে যারা মেধাবী, তাদের ব্রিটেন থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হতো। তবে হ্যারিস ও শ্যামালা রাজি ছিলেন না ব্রিটেনে যেতে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। হ্যারিসের জন্য বিষয়টা সহজ হলেও শ্যামালার জন্য ছিল কঠিন। কারণ তিনি একজন নারী।
ভারতের এক উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ পরিবারের বড় সন্তান শ্যামালা। তিনি চেয়েছেন বায়োকেমিস্ট হতে। তবে তাকে বাধ্য করা হয় ব্রিটিশদের নির্মিত লেডি অরউইন কলেজে গার্হস্থ্যবিজ্ঞানের ডিগ্রি নিতে। তার বাবা আর ভাইয়েরা ভেবেছিলেন এটাই যথেষ্ট।
তার ভাই গোপালান বালাচন্দ্রান বলেন, ‘আমরা তার সঙ্গে এমনভাবে মজা করতাম, যেন আমাদের কোনো দায় ছিল না। আমরা তাকে বলতাম গার্হস্থ্যবিজ্ঞানে তুমি কী পড়েছ? কীভাবে ডিনারের প্লেট সাজাতে হবে এসব?’
এর মধ্যে নিজ উদ্যোগে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে প্রাণরসায়নের ডিগ্রি অর্জন করেন শ্যামালা। তবে তার বাবা এতে ভয় পেয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিচিত কেউ নেই, কীভাবে শ্যামালা থাকবেন এ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাকে আশ্বস্ত করেন শ্যামালার ভাই। শ্যামালার পড়াশোনার খরচের দায়িত্বও তিনি নেন।
১৯৬১ সালে কয়েক হাজার মাইল দূরের হ্যারিসের জীবনেও একই ঘটনা ঘটে। তিনি অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে সম্মানসূচক বৃত্তিও দিয়েছিল ব্রিটেনে পড়ার জন্য। তবে ব্রিটিশ সংস্কৃতি পছন্দ করতেন না হ্যারিস। তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই যাবেন বলে ঠিক করলেন। তার কাছে মনে হতো যুক্তরাষ্ট্র অনেক জীবন্ত, অনেক পরিবর্তনশীল, বিচিত্র ও জটিল একটি দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রে এসে শ্যামালা জড়িয়ে পড়েন একদল বৃদ্ধিজীবীর সঙ্গে। সেখানে তিনি আফ্রো-আমেরিকান পাঠচক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬১ সালে হ্যারিসও সেই পাঠচক্রে যুক্ত হন।
এর পরই হ্যারিস ও শ্যামালার প্রেম হয়। তারা বিয়ে করারও সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৪ সালে তাদের প্রথম সন্তান কমলার জন্ম হয়। কমলার যখন পাঁচ বছর, তখন হ্যারিস ও শ্যামালার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। শিক্ষকতার সূত্রে হ্যারিস উইসকনসিনে চলে যান, শ্যামালা থেকে যান অকল্যান্ডে।
এই দূরত্ব পছন্দ হয়নি শ্যামালার। তিনি নিজেই নিজের পথে চলার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে তিনি কমলা ও তার বোনসহ দুই মেয়েকে নিয়ে অকল্যান্ডেই থেকে যান। নিজেদের দুই মেয়েকে তিনি বড় করতে থাকেন কৃষ্ণাঙ্গদের মতো করেই।
সেই বিচ্ছেদের সময় নিয়ে কমলা তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, তখন আমার মনে হয়েছিল বাবা আর মা যেন তেল আর জল। আমি ভাবতাম হয়তো তারা অনেক পরিণত বয়সে পৌঁছে গেছেন, তাই এমন হচ্ছে।
এরপর ১৯৭২ সালে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আদালতে আবেদন করেন শ্যামালা। তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কমলা জানান, আমার বাবাই ছিলেন আমার মায়ের একমাত্র ছেলেবন্ধু। এরপর কৃষ্ণাঙ্গদের সমাজে বেড়ে উঠতে থাকেন তারা। ২০০৯ সালে সেখানেই মারা যান শ্যামালা।
তবে কমলার বাবা এখনো বেঁচে আছেন। তিনি একজন আমেরিকান-জ্যামাইকান অর্থনীতিবিদ হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। সব সময় নিজ দেশ, মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার তিনি। শ্যামালার সঙ্গে দীর্ঘ প্রেমের পর বিচ্ছেদ তিনি মেনে নিতে পারেননি। শ্যামালাকে আজও তার মনে পড়ে।
সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস