সময়টা ১৯৯২ সাল। তিনজন তরুণ ছেলে মঞ্চে ওঠে। সেটি ছিল কোরিয়ার এক টেলিভিশন ট্যালেন্ট প্রতিযোগিতা।
কোরিয়ান কথা, ইউরো পপ, আফ্রিকান আমেরিকান হিপ হপ ও র্যাপের সমন্বয়ে নতুন ধরণের গান, নাচও পুরো খাপে খাপ তাল মিলিয়ে। উপস্থিত দর্শকদের মুহুর্তেই মাতিয়ে ফেলে তারা।
কিন্তু স্যুট পরা বিচারকেরা খুব একটা মুগ্ধ হলেন না। স্কোরকার্ড দেখালেন তারা। ব্যান্ডটি সে রাতে সর্বনিম্ন নম্বর পেয়ে শো থেকে বাদ পড়ে যায়। কিন্তু বিচারকদের সেদিনকার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।
কিছু দিনের মধ্যেই ‘আই নো’ নামের গানটি টপ চার্টের একদম উপরে উঠে যায় এবং ১৭ সপ্তাহ পর্যন্ত শীর্ষে থেকে সব রেকর্ড ভেঙ্গে দেয়। সেই রাতের ব্যান্ডদল ‘সেও তাইজি অ্যান্ড বয়েজ’ সূচনা করে এক বিপ্লবের।
কোরিয়ান পপ বা কে-পপের সূচনা সেখানেই যেটি এখন মাল্টি-বিলিয়ন-ডলার ইন্ডাস্ট্রি।
বিটিএস বা ব্ল্যাকপিংকের মতো ব্যান্ড আমেরিকা, ইংল্যান্ড বা যে কোনো আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম মুহুর্তেই কাঁপিয়ে দিতে পারে।
বিশ্বের বেস্ট-সেলিং শিল্পী হিসেবে ২০২০ সালে উঠে আসে বিটিএসের নাম। ২০১৯ ও ২০২২ এ তারা ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে।
বাংলাদেশেও গড়ে উঠেছে কে-পপের বড় ফ্যানবেজ।
যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনিকা তাবাসসুম বলছিলেন, শিল্পীদের পরস্পরের প্রতি বিনয় এবং শালীনতা তাকে কে-পপ বা কে-ড্রামার ব্যাপারে আকৃষ্ট করে।
কীভাবে বিশ্ব কাঁপালো সেই কে-পপ? এর পেছনে বেশ কিছু গল্প আছে।
সেই সময়, বার্নি চো এমটিভিতে কাজ করছিলেন। তিনি জানান যে তরুণ কোরিয়ানরা বেশিরভাগই পশ্চিমা সঙ্গীত শুনছিল এবং কোরিয়ান সঙ্গীতের শ্রোতা ছিল তাদের মা-বাবার প্রজন্ম। কিন্তু ১৯৯২ সালে তা বদলাতে শুরু করে।
“এটা বিবর্তন না, বরং অনেকটা বিপ্লবের প্রক্রিয়া ছিল,” জানান চো।
‘সেও তাইজি অ্যান্ড বয়েজ’-এর সেই ট্যালেন্ট শো’র পারফরমেন্স দক্ষিণ কোরিয়ার টিভি এবং রেডিওতে লাইভ সম্প্রচার হয়েছিল।
সেই একটা শো তরুণ কোরিয়ান শিল্পীদের বিশ্বের অন্যন্য জায়গা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগীত সৃষ্টির একটা নতুন দুয়ার খুলে দেয়।
১৯৯০ এর শেষের দিকে ক্লোনের মতো শিল্পীরা চীন ও তাইওয়ান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তখন জাপানের বাজার ধরতে পারা একটা বড় ব্যাপার ছিল। সেটা সম্ভব হয় যখন ২০০২ সালে কোরিয়া ও জাপান মিলে ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন করে।
‘কে-পপের রানী’ হিসেবে পরিচিত বোয়া জাপানের টপ চার্টে উঠে আসে কয়েকবার। “এটি এক বিরল ঘটনা এবং একটি অনুপ্রেরণামূলক অর্জন ছিল,” বলেন চো ৷
২০০৮ সাল থেকে কে-পপ এশিয়ার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। চীন বা জাপানের নিজস্ব সামাজিক মাধ্যমের বাইরে ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউবের মতো আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে চলে আসে কোরিয়ান কোম্পানিগুলো।
সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা ছিল ২০১২ সালে সাইয়ের গ্যাংন্যাম স্টাইল – যেটা ইউটিউব ভিউয়ের দিক থেকে সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। বিশ্ব জুড়ে পরিচিতি বাড়তে থাকে কে-পপের।
আমেরিকার একজন কলেজ শিক্ষার্থী হ্যানা ওয়েইট গবেষণার জন্য একটা বিষয় খুঁজছিলেন যখন তার সামনে আসে কে-পপ।
“একজনের পোস্ট করা একটা কে-পপ ভিডিওর প্রোডাকশন, রঙ, শব্দ সবকিছু দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। প্রথমে মনে হয় এটা মাকারিনার মতো কিছু হবে। একটা ধাক্কা দিয়ে শেষ এবং এরপর অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে,” বলছিলেন মিজ ওয়েইট।
কিন্তু শীঘ্রই তিনি বোঝেন এটা মাকারিনার মতো না। অনলাইনে ইংরেজিতে তেমন কিছু খুঁজে না পেয়ে নিজে একটি ওয়েবসাইট খোলেন। বিনোদন ও কে-পপ নিয়ে তথ্য, খবর দেয়ার উদ্দেশ্যে মুন-রক নামে সে সাইটটি খোলা হয়। ২০১৪ সালে খোলার পর প্রথম দিনই সেটি ক্র্যাশ করে।
“রাতারাতি ১৫ হাজার মানুষ আসার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না, আমাদের সার্ভারের ধারণক্ষমতাও এত ছিল না,” বলছিলেন তিনি।
মিজ ওয়েইট ব্যান্ডগুলোর গোড়াপত্তন নিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে থাকেন। পশ্চিমা বিশ্বের পপ গ্রুপগুলোকেও গড়ে তোলা হয়, কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় তাদেরকে প্রায় চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেটা একেবারে লক্ষ্য ঠিক করে করা হয়।
সেখানে শিশুদেরকে বেছে এনে নিয়োগ করা হয় – যারা খুব অল্প বয়সেই শুরু করে। “১০ থেকে ১৪ বয়সের যে কাউকে নিয়োগ দেয়া হতে পারে এভাবে যে এজেন্সির কোনো লোক হয়তো তাকে কোনো শপিং মলে দেখেছে এবং তাদের কাছে মনে হয়েছে শিশুটি দেখতে সুন্দর,” বলছিলেন মিজ ওয়েইট।
একজন কে-পপ তারকা তৈরির জন্য একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলা এবং নিয়মকানুন রয়েছে।
মূলত তিনটি সংস্থা বা এজেন্সি আছে যাদের প্রত্যেকের ২০০ পর্যন্ত প্রশিক্ষণার্থী রয়েছে। ছোট আকারেও আরো কয়েকটি আছে। সমস্ত কে-পপ ব্যান্ড সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসে।
নিয়োগপ্রাপ্তরা হয় বাড়িতে থাকে বা ছাত্রাবাসে থাকে। তাদেরকে একটি কঠিন নিয়মকানুনের মধ্যে থাকতে হয়।
“আপনি ঘুম থেকে উঠবেন, সম্ভবত ভোর ৫টা। কোরিওগ্রাফি ক্লাস বা কণ্ঠশীলন দিয়ে কিছুটা ট্রেনিং করবেন। দলে আপনার ভূমিকা কী তার উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত একটি বিশেষ সময়সূচী সাজানো হবে,” বলছিলেন মিজ ওয়েইট।
“এরপর তারা প্রায় ৩ টা পর্যন্ত স্কুলে যায়, এরপর আবার সেই বিনোদন সংস্থায় ফিরে যায় যেখানে তারা প্রায় ১১ টা পর্যন্ত আরো অনুশীলন করে। সোওলে ট্রেনগুলি মধ্যরাতে বন্ধ হয়ে যায়, তাই তারা সেই শেষ ট্রেনে উঠে, বাড়ি গিয়ে পাঁচ ঘন্টা ঘুমায় এবং আবার শুরু করে।”
এই উদীয়মান তারকাদের এখনও আত্মপ্রকাশ হয়নি। যদি সেটা হয়ে যায় তারপর হয়তো আরো আগে উঠে শুরু করতে হবে।
হ্যানা ওয়েইট জানান, মাঝে মাঝে প্রশিক্ষণার্থীরা রাতে বড়জোর দুই ঘন্টা ঘুমায়।
“একবার একটা কিছু প্রকাশ হয়ে গেলে এবং প্রথম একটা পারফরম্যান্সের পর ঘড়ির কাঁটা আবারো দৌড়াতে থাকে। কারণ যদি সে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, তখন তার ঠিক পিছনে আরো ক্ষুধার্ত, আরো উচ্চাভিলাষী তরুণদের একটি দল তাকে সরিয়ে জায়গা করে নিতে মুখিয়ে থাকবে,” – জানাচ্ছিলেন মিজ ওয়েইট।
“তাই এর প্রতিটা পয়সা উসুল করতে তাকে জোর করে হলেও নিজেকে টেনে নিতে হবে।”
গত কয়েক বছর ধরে, কে-পপ তারকাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা স্বীকার করার সংখ্যা বেড়েছে।
বড় একটি দল ‘শাইনি’র মূল গায়ক জং-হিয়ান ২০১৭ সালে ২৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন যিনি তারকাখ্যাতির সাথে সাথে বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। টি.ও.পি. নামে আরেক তারকার মৃত্যু হয় মাত্রাতিরিক্ত অ্যাংজাইটির ওষুধের কারণে। সাম্প্রতিক এপ্রিলে (২০২৩) তারকা মুনবিনের মৃত্যু হয় মাত্র ২৫ বছর বয়সে, যেটাকেও আত্মহত্যা হিসেবেই ধারণা করা হয়।
কে-পপ তারকারা ১৩ বছরের চুক্তিতে আবদ্ধ থাকতেন। এই মেয়াদ আইনগতভাবে কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে।
“এটি আসলে কিছু কে-পপ তারকাদের বের হয়ে আসা এবং চুক্তিগুলিকে হাস্যকর বলার কারণে হয়েছে।”
‘আমি রাতে দুই ঘন্টা ঘুমাই৷ আমি এসব শোতে যেতে চাই না। কিন্তু যদি আমি না গেলে আমাকে জরিমানা করা হবে এবং আমি মূলত ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত আটকে থাকব, কারণ এই চুক্তিগুলি অনেক দীর্ঘ” – বলছিলেন হ্যানা ওয়েইট। তারা ‘দাস চুক্তি’ শব্দটি তৈরি করেছিল।
কে-পপ যত বেশি সফল হয়েছে, দেশটির শাসকগোষ্ঠীও তত বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
“দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যবসায়ী নেতারা এবং রাজনৈতিক নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিধি বাড়ানো দরকার,” বলছিলেন ইয়াং লী, যিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং একই সাথে কে-পপ নিয়ে লেখালেখি করেন।
“তরুণরা বিশেষভাবে কোনো কিছু নিয়ে কথা বললে সেটা ছিল হয় দক্ষিণ কোরিয়ার নাটক বা দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় সঙ্গীত।”
সরকার সঙ্গীত শিল্পকে ট্যাক্স ছাড় দিয়ে তুলে ধরতে শুরু করেছে। তারা এই শিল্পের জনপ্রিয়তা বাড়াতে শিক্ষাবিদদের অর্থ দেয় এবং বিদেশী দূতাবাসগুলি এই গোষ্ঠীগুলির প্রচার করে।
এটি কাজে লেগেছে এবং বড় ব্যবসাও এনেছে। ইয়াং লী উল্লেখ করেন, এখানেই শেষ হয়নি।
“প্রভাবটি শুধু আর্থিক না, বরং বিদেশে একটা জনপ্রিয়তা তৈরি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যন্য দেশে একটা পরোক্ষ ক্ষমতা বা প্রভাব বাড়াতে গুরুত্ব রেখেছে।”
কোরিয়ান সংস্কৃতির এই ঢেউকে বর্ণনা করার জন্য একটি শব্দও আছে: হ্যালিউ। কে-পপ সৌন্দর্য ব্যবসার মত অন্যান্য লাভজনক শিল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
“উদাহরণস্বরূপ, কসমেটিকস, প্লাস্টিক সার্জারি এবং সৌন্দর্য শিল্পের অনেক কিছু কে-পপের উপর নির্ভর করে। বিশেষত এমন একটা চিত্র প্রচার করতে যে আপনি যদি এই দক্ষিণ কোরিয়ান পণ্য ও সেবা ব্যবহার করেন তাহলে আপনি কে পপ তারকাদের মতো দেখতে সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবেন,” বলেন মি. লী।
তাঁর মতে দক্ষিণ কোরিয়ার একটা বড় জনগোষ্ঠী চেহারা বা শরীরে কৃত্রিমভাবে কোনো না কোনো পরিবর্তন আনে যেটা খুব ভালো কিছু না।।
“গত কয়েক দশকে এটি বেড়েছে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে এক ব্যাপক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার অংশ এই কে-পপ,” বলেন ইয়াং লী।
তাহলে কিভাবে এই কে-পপ পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিলো? চাতুর্যের সাথে তৈরি একটা নকশা আর দুর্দান্ত বিপণনব্যবস্থা।
শুধু তাই নয়, এটা কোরিয়ার সংস্কৃতির একটা বহিঃপ্রকাশ এবং সরকার এর সাফল্যকে পুঁজি করে বেশ খুশিই হয়েছে।
কে-পপ পণ্যের উপাদান হল মানুষ। তাদের কারও কারও বয়স মাত্র ১০ বছর – যাদেরকে অত্যন্ত কঠিন শাসনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর অন্ধকার দিকটা সরকার প্রচার করতে চায় না।
সঙ্গীতে হয়তো এর প্রভাব নেই, কিন্তু বিশ্বকে জয় করার পেছনে তাদের মূল্যটাও কম দিতে হয় না।
সূত্র: বিবিসি