২০১৯ সালে আধুনিক দাসত্ব আইন কার্যকর করে ব্রিটেন৷ সেসময় এই উদ্যোগ ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল৷ বিশেষ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সরবরাহ চেইনের দাসত্ব প্রতিরোধ এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তির জন্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে আইনটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷
কিন্তু অনিয়মিত অভিবাসন রোধে ২০২৩ সালে কার্যকর হওয়া আইন এই প্রচেষ্টাকে ম্লান করে দিয়েছে৷ সরকারি কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচার ব্যবস্থার সদস্য এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স৷ সাক্ষাৎকারদাতাদের মতে ব্রিটেনের কঠোর অভিবাস আইনের কারণে হাজার অভিবাসী আধুনিক দাসত্বের ফাঁদে পড়ছেন৷ বিপদে পড়ে একদিকে সহায়তা যেমন পাচ্ছেন না তারা, অন্যদিকে ডিপোর্ট বা প্রত্যাবাসনের ভয়ে অনেকে এ বিষয়ে অভিযোগ জানাতেও ভয় পাচ্ছেন৷
আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার বাড়ছে
দাসত্ব আইনের অধীনে রাষ্ট্রের সুরক্ষা পাওয়ার জন্য একজন ব্যক্তিকে এখন আগের চেয়ে বেশি শোষণের তথ্য-প্রমাণ দিতে হয়৷ ২০২৩ সালে ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ দিতে না পারার কারণে আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, যেখানে ২০২২ সালে এই হার ছিল মাত্র ১১ শতাংশ৷ আর ২০২৪ সালে বছরের প্রথম নয় মাসের হিসাবে আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার ছিল ৪৬ শতাংশ৷
২০২৩ সালে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৭ হাজার জনকে আধুনিক দাসত্বের সম্ভাব্য শিকার হিসেবে চিহ্নিত করে৷ গত বছরের নয় মাসে এই সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৫৮৭ জন৷ আধুনিক দাসত্বের সম্ভাব্য শিকার হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিবেচিত এই সংখ্যার বেশিরভাগই অভিবাসী৷ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী মূলত সেলুন, গাড়ি পরিষ্কার, যৌনকর্মী বা অবৈধ মাদক চোরাচালানের কাজে এই অভিবাসীদের ব্রিটেনে আনা হয়৷
তবে এই পরিসংখ্যানগুলো প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না৷ অক্টোবরে হাউস অব লর্ডস কমিটির একটি প্রতিবেদনে ব্রিটেনে এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ আধুনিক দাসত্বের শিকার বলে উল্লেখ করা হয়৷
প্রতিবেদনে দাসত্ব আইন কার্যকরে সরকারকে অভিবাসন আইন সংস্কারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে৷ বলা হয়েছে, ‘‘২০১৫ সালে আধুনিক দাসত্ব আইন পাসের পরে তা বিশ্বে প্রথম হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল৷ কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি আর নেই৷’’
বিরোধী দলে থাকতে বিগত সরকারের অভিবাসন আইন নিয়ে কড়া সমালোচনা করলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি আইন পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন সরকার আধুনিক দাসত্বের জন্য যারা সুরক্ষার আবেদন জানিয়েছেন তাদের আবেদনের জট ছাড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ সেই সঙ্গে শোষণের জন্য অপরাধী চক্রকে শাস্তির আওতায় আনার কাজ চলছে৷ রয়টার্সকে ঐ মুখপাত্র বলেন, ‘‘কয়েক হাজার মানুষকে বিশেষ করে নারী ও শিশুদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক কাজে নিয়োজিত করা হবে, নিয়মিত তারা শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হবে আজকের ব্রিটেনে এমনটা মেনে নেয়া যায় না৷’’
আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ
ব্রিটেনে আধুনিক দাসত্ব আইন পাসের সময়কার প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে একে সময়ের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার ইস্যু হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন৷
কিন্তু ২০১৯ সালে তিনি ক্ষমতা ছাড়ার পরে কনজারভেটিভ সরকার এই আইনের সমালোচনা করে৷ অনিয়মিত অভিবাসীরা ডিপোর্টেশন এড়াতে আইনটিকে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করা হয়৷ এর প্রেক্ষিতে এই আইনের অধীনে সুরক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে দাসত্বের আরো তথ্য প্রমাণ হাজিরের বিধান যোগ করা হয়৷
অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী এলিজাবেথ বাটলার-স্লস আইনটি পরীক্ষা নিরীক্ষার দায়িত্বে থাকা হাউস অব লর্ডস কমিটিতে ছিলেন৷ তিনি বলেন অভিবাসীরা আইনটির অপব্যবহার করছে এমন তথ্য-প্রমাণ সরকার হাজির করতে পারেনি৷
তথ্য-প্রমাণের ঘাটতি
এই আইনের সুরক্ষা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়া একজন ফিলিপিনো জানিয়েছেন, তাকে একটি বাড়ি দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত করা হয়েছিল৷ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করার পাশাপাশি শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হতেন বলে তিনি দাবি করেন৷ কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ নেই এমন কারণ দেখিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তার সুরক্ষার আবেদন গ্রহণ করেননি৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২২ সালে অপর্যাপ্ত তথ্যের কারণে আবেদন প্রথম পর্যায়ে বাতিল হওয়ার হার ছিল তিন থেকে চার শতাংশ৷ ২০২৩ সালে তা ৫৪ শতাংশে পৌঁছায়৷ আর ২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসে তা ৫৩ শতাংশে দাঁড়ায়৷
দাতব্য সংস্থাগুলো বলছে, এসব ক্ষেত্রে বিপদের শিকার ব্যক্তির পক্ষে অকাট্য প্রমাণ হাজির করা অনেকটাই অসম্ভব৷ বিশেষ করে যারা অপরাধীর হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়ান তার পক্ষে এটি কঠিন৷
বিদেশিদের সঙ্গে বৈষম্য
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম অভিবাসী ও ব্রিটেনে নাগরিকদের মধ্যে আধুনিক দাসত্ব আইনের সুরক্ষা পাওয়ার বৈষম্যমূলক চিত্র তুলে ধরেছে৷ আইওএম এর বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০২৩ সালে নয় মাসের হিসাবে ব্রিটেনের নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রথম স্তরে আবেদন গৃহীত হওয়ার হার ছিল ৮৫ শতাংশ৷ যেখানে বিদেশিদের ক্ষেত্রে এই হার ৪৪ শতাংশ৷ আগের বছরগুলোতে এই ব্যবধান অনেক কম ছিল বলে জানিয়েছে আইওএম৷
২০২৩ সালে নয় মাসে প্রথম স্তরে বাতিল হওয়া ৬৮ শতাংশ আবেদন পুনর্বিবেচনায় গৃহীত হয়েছিল, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ কর বলে মনে করেন আইওএম এর বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক বুরল্যান্ড৷
ফিলিপিনো সেই নারী জানিয়েছেন প্রাথমিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তিনিও পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েছেন৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে আবেদন গৃহীত হলে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দাসত্বের শিকার হিসেবে চিহ্নিত হবেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় ব্রিটেনে অবস্থানের অনুমতি পাবেন৷
অফিসিয়াল পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এমন ২০ হাজার আবেদনকারী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন৷
সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলে ভুক্তভোগীরা সরকারের কাছ থেকে সপ্তাহে ৭৫ পাউন্ডের ভাতা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী থাকার ব্যবস্থা পেয়ে থাকেন৷ তবে অনেক অভিবাসীই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগ পর্যন্ত কাজ করার অনুমতি পান না৷
এই আইনের অধীনে ভুক্তভোগীকে শনাক্ত করা ও সহায়তার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২৩-২৪ সালে ১৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার খরচ করেছে৷ এর বাইরে শিশুদের জন্য একটি প্রকল্পেও ব্যয় করা হয়েছে৷
রয়টার্স