বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের পর্যটন নগরী কক্সবাজার। দেশ-বিদেশের লাখো পর্যটক ভ্রমণ করলেও জেলাটিতে ছিল না রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা। সেই অপেক্ষা এবার ফুরাচ্ছে। দেশের সর্ব দক্ষিণের জেলায় শিগগিরই চালু হচ্ছে রেল। সেপ্টেম্বরেই হওয়ার কথা রয়েছে ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেনের প্রথম ট্রায়াল রান।
কক্সবাজারের উন্নয়নের জন্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্প। প্রকল্পগুলো এই জেলায় হলেও এর সুফল পাবে পুরো দেশ। সাগরের বুকে বিমানবন্দরে দেশের দীর্ঘতম রানওয়ে নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে। চলতি বছরই সমুদ্র ছুঁয়ে ওঠানামা করবে উড়োজাহাজ। পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালীতে হচ্ছে তেল পরিবহনের জন্য ইনস্টলেশন অব সিংগেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্প। প্রকল্পটি চালু হলে জ্বালানি তেল খালাসে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
এদিকে দেশের গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে মাতারবাড়ীর কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এশিয়ান হাব হিসেবে জাহাজগুলোর জন্য যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে বন্দরটি পরিচিতি পাবে। এতে মহেশখালী দ্বীপ পরিণত হবে দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক জোনে। এছাড়া বন্দরের উপকূল ঘেঁষেই মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নের ১ হাজার ৪১৪ একর জমির ওপর তৈরি হয়েছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর প্রথম ইউনিট উৎপাদন শুরু করে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করেছে।।
এর বাইরে খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কক্সবাজার, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, মেরিন অ্যাকুরিয়াম স্থাপনের মতো প্রকল্পের মধ্য দিয়ে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্পে বদলে যাচ্ছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার।
কক্সবাজারে রেল, যোগাযোগে নতুন মাত্রা
২০১০ সালে ঢাকা-কক্সবাজার রেল চলাচলের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু হবে। প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই পথে রেলস্টেশন থাকছে ৯টি। পুরো প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৩৯১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজার সদরের ঝিলংজায় নির্মিত হচ্ছে আইকনিক রেলস্টেশন। সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক স্থাপন ও স্টেশনের কাজ এরই মধ্যে ৮৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সড়কপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে যেখানে সময় লাগে সাড়ে ১১ ঘণ্টা, ট্রেনে পৌঁছাতে সেখানে লাগবে মাত্র সাড়ে ৬ ঘণ্টা। কমে আসবে পরিবহন ব্যয়ও। চলতি বছরেই চালু হবে ঢাকা-কক্সবাজার রেল চলাচল। আর এর মাধ্যমেই খুলতে যাচ্ছে রেলের দক্ষিণের দুয়ার।
ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে স্থানীয় মানুষের মধ্যে। ঢাকার সঙ্গে ট্রেনের যোগাযোগ ও দৃষ্টিনন্দন রেল স্টেশন নিয়ে উচ্ছ্বসিত কক্সবাজারবাসী।
ঝিলংজা স্টেশন এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, বাড়ির কাছেই আসবে চট্টগ্রাম বা ঢাকা যাওয়ার ট্রেন। ফলে সকালে বা রাতে যেকোনো সময় টিকিট কেটেই কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়া চট্টগ্রাম বা ঢাকায় চলে যেতে পারবো।
সাগরের মাঝে রানওয়ে
কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকতের তীর ঘেঁষে চলছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের নির্মাণকাজ। সমুদ্রের জলরাশির ওপর রানওয়ের এক প্রান্ত থাকবে। দিনরাত সাগরজল ছুঁয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা করবে এই রানওয়েতে। রানওয়ের নির্মাণকাজ শেষ হলে অনেকটা ভাসমান রানওয়েতে নামবেন বিমানে আসা যাত্রীরা। অবতরণের সময় যাত্রীদের মনে হবে, যেন সাগরেই নামতে যাচ্ছেন তারা। এমন ব্যতিক্রম অনুভূতি দেওয়ার পাশাপাশি কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্বের দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দরের তালিকায় স্থান পেতে যাচ্ছে এই বিমানবন্দর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বিমানের রিফুয়েলিংয়ের জন্য সবাই দুবাইকে গেটওয়ে হিসেবে ব্যবহার করে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেও ২০০ ফুট বড় রানওয়ে সমৃদ্ধ কক্সবাজার বিমানবন্দর আগামীতে আন্তর্জাতিক আকাশপথের রিফুয়েলিং হাব হবে। রানওয়ে পরিষেবা চালু হলে বোয়িং ৭৭৭ এবং বোয়িং ৭৪৭-এর মতো বড় বিমানগুলো কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করতে সক্ষম হবে।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর
মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নের ১ হাজার ৪১৪ একর জমির ওপর তৈরি হয়েছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। যেখানে প্রথম ইউনিট উৎপাদন শুরু করে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করেছে। আরও ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। কয়লা পরিবহনের জাহাজ জেটিতে আসার পরিকল্পনা থেকেই মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে এশিয়ান হাব হিসেবে জাহাজগুলোর জন্য যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে বন্দরটি পরিচিতি পাবে। এতে মহেশখালী দ্বীপ পরিণত হবে দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক জোন।
একসময় যেটি ছিল অনেকটা অসম্ভব কাজ, এখন তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। এরই মধ্যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। চলছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামোর কাজ। ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীরতার বন্দর নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এটি চালু হলে মাতারবাড়ীতে ১৬ মিটার গভীরতার জাহাজও ভিড়তে পারবে, যা এশিয়ার এ অঞ্চলে প্রথম।
অত্যাধুনিক জলবায়ু উদ্বাস্তু আশ্রয়ণ প্রকল্প
বর্তমান সরকার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কক্সবাজারের জলবায়ু উদ্বাস্তু ভূমিহীন-গৃহহীন-ছিন্নমূল অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ গ্রহণ করে। ২০২০ সাল থেকে কক্সবাজার সদরের খুরুশকুলে বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বাসস্থান তৈরির কাজ শুরু করে সরকার। ২৫৩ দশমিক ৫৯ একর জমির এই প্রকল্পটিতে এক হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচতলা বিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ভবনে রয়েছে ৩২টি করে ফ্ল্যাট, প্রত্যেক ফ্ল্যাটে থাকবে একটি করে পরিবার। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন (মোট ব্যবহারযোগ্য) ৪০৬ দশমিক ৭ বর্গফুট, প্রতিটি তলায় রয়েছে কমন সার্ভিস সুবিধা।
প্রকল্পের ১৩৯টি ভবনের মধ্যে এরই মধ্যে ২০টি ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। এরমধ্যে ১৯টি ভবনে ৬০০টি পরিবার প্রায় তিন বছর ধরে বসবাস করছে। কাজ চলমান থাকা বাকি ভবনগুলোরও কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে এসব ভবনে উপকারভোগীরা উঠতে পারবেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পটিতে পুনর্বাসন করা হবে চার হাজার ৪০৯টি পরিবারকে। প্রতিটি পরিবারের জন্য রয়েছে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, সুয়ারেজ লাইন, সোলার প্যানেল, প্রতিটি ভবনে রয়েছে গেস্ট হাউজ, রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন সবকিছু। এছাড়া অভ্যন্তরীণ পাকা রাস্তা ২০ কিলোমিটার।
উপকারভোগীদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য একটি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রয়েছে ১৪টি খেলার মাঠ, তিনটি পুকুর, একটি মসজি ও একটি মন্দির। নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও বাফার জোন স্থাপন করা হবে। প্রকল্পটি বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
কক্সবাজারের এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে রাজধানী ঢাকার পর সবচেয়ে আধুনিক শহরে রূপ নেবে কক্সবাজার।
গত এক যুগ ধরে চলা এসব উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের নেওয়া নানান উন্নয়নমূলক প্রকল্প বদলে দিয়েছে পুরো কক্সবাজারকে। সবচেয়ে বেশি মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এরপরই নেওয়া হয়েছে কক্সবাজারে। এসব প্রকল্প বদলে দিয়েছে পুরো কক্সবাজারকে। প্রকল্পগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজার হবে একটি উন্নত ও পরিপূর্ণ পর্যটন নগর।
তিনি বলেন, মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে দেশের সর্বপ্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর জাপানের দুটি ব্যস্ততম বন্দর নিগাতা এবং কাশিমারর আদলে নির্মাণ করা বন্দরটি হতে যাচ্ছে এশিয়ান হাব। বঙ্গোপসাগরে বিস্তৃত সুনীল অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে মেরিন অ্যাকুরিয়াম স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনা ও সম্পদ কাজে লাগিয়ে খুলবে নতুন অর্থনীতির দুয়ার।