ভিসা ছাড়া ভ্রমণের মজাই আলাদা। কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই, শুধু প্লেনের টিকিট কেটে চলে গেলেন ঘুরতে। জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড বা আমেরিকার নাগরিকেরা ভিসা ছাড়াই ঘুরে আসতে পারেন প্রায় গোটা পৃথিবীটা। অর্থাৎ এসব দেশের পাসপোর্টে ভিসামুক্ত সুবিধা আছে বেশিরভাগ দেশে। সে হিসেবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট খুব একটা প্রভাবশালী নয়।
হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স ২০২৩ অনুসারে, ভিসা ছাড়া বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে ৪০টি দেশে প্রবেশ করতে পারবেন। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু দেশ ভ্রমণ করতে ভিসা লাগবে না, কিছু দেশে পৌঁছার পর ভিসা মিলবে আর শুধু শ্রীলঙ্কার জন্য লাগবে ই-টুরিস্ট ভিসা। অর্থাৎ আগে-পরে কখনই ভিসার জন্য পাসপোর্ট নিয়ে সশরীরে হাজির হতে হবে না।
বাকি দেশগুলোর মধ্যে ২০টি দেশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে ভিসামুক্ত ভ্রমণ করা যাবে অর্থাৎ আগে-পরে কখনোই ভিসা নিতে হবে না। ১৯টি দেশ দেয় অন-অ্যারাইভাল ভিসা অর্থাৎ সেসব দেশে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরে ভিসা দেওয়া হয়।
এই ৪০টি দেশের মধ্যে ওশেনিয়ার দেশ সাতটি, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ ১১টি, এশিয়ার পাঁচটি, আফ্রিকার ১৬টি ও দক্ষিণ আমেরিকার একটি।
এশিয়া
তালিকায় এশিয়া মহাদেশের দেশের সংখ্যা পাঁচটি। এগুলো হলো ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পূর্ব তিমুর। এগুলোর মধ্যে পূর্ব তিমুর, নেপাল ও মালদ্বীপে বিমানবন্দরে অন অ্যারাইভাল ভিসা মিলবে অনায়াসে। শ্রীলঙ্কার জন্য অবশ্য লাগবে ইলেকট্রনিক ট্রাভেল অথোরাইজেশন বা ইটিএ নামের এক ধরনের ইলেকট্রনিক অনুমোদন।
তবে ঘোরার জন্য এশিয়ার এই পাঁচ দেশই আদর্শ। ভুটানের দূষণমুক্ত বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখার মজাই আলাদা। একবার সেখানে পৌঁছে গেলে আর আসতে মন চাইবে না। সাধারণ পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য রাজধানী থিম্পু, পারো, পুনাখার মতো জায়গাগুলি। এসব জায়গায় যে পাহাড়ি নদীগুলো পাবেন সেগুলোর সৌন্দর্যে মোহিত হবেন। থিম্পুর বুদ্ধ পয়েন্টের বিশাল বুদ্ধ মূর্তি আর সেখান থেকে দেখা পাহাড়ের দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। জিগমে দর্জি ন্যাশনাল পার্ক আবার বাঘের আস্তানা হিসেবে মশহুর। পারোর কাছে অবস্থিত টাইগার নেস্ট বিশেষ করে যারা ট্র্যাকিং করেন তাঁদের পছন্দের তালিকায় ওপরের দিকে থাকে। পুনাখার ঝুলন্ত সেতুও দেখার মতো।
নেপালে গেলে পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে যেতে পারেন নাগরকোট, পোখারায়। ভোরে এই দুই জায়গা থেকেই দেখবেন হিমালয়ের তুষার ধবল সব চূড়া। ফেলুদার যত কাণ্ড কাঠমান্ডু যারা পড়েছেন তাঁরা দেশটিরে রাজধানী শহর কাঠমান্ডুতে দুটি দিন নিশ্চিতভাবে কাটাতে চাইবেন। আবার চিতওয়ানের জঙ্গলে হাতির পিঠে চড়ে দর্শন পাবেন গন্ডারের।
সাগর যারা ভালোবাসেন তাঁরা অবশ্য মালদ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। শ্রীলঙ্কায় সাগর, পাহাড়, বন্যপ্রাণী, মন্দির, দুর্গ, চা বাগান মোটামুটি সবকিছুই পাবেন। এদিকে মাত্র ১৫ হাজার বর্গ কিলোমিটারের পূর্ব তিমুরে পর্যটকের তেমন যাওয়া-আসা শুরু না হলেও এখানকার সাগর সৈকত, পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলেও যেতে পারেন। তেমনি স্কুবা ডাইভিং করে সাগর তলের আশ্চর্য জগৎও দেখতে পারবেন সেখানে।
ক্যারিবীয় অঞ্চল
ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীপরাষ্ট্রের খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল আমাদের কাছে বেশ পরিচিত হলেও ওই অঞ্চলে দেখার মতো কী আছে সে সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। অথচ ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে এখানকার দ্বীপ দেশগুলো অসাধারণ। আশ্চর্য সুন্দর সাগর সৈকত, নানা পদের খাবার, উৎসব সবকিছু মিলিয়ে সেখানে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়।
শুনে খুশি হবেন ওই অঞ্চলের বাহামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, বার্বাডোজ, ডোমিনিকা, গ্রেনাডা, হাইতি, জ্যামাইকা, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, মনটসেরাট, সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্র্যানাডাইনস, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর মতো জায়গাগুলো ঘুরে আসতে কোনো ভিসার প্রয়োজন হয় না বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের। ও একটা কথা বিখ্যাত ক্রিকেটার ব্রায়ান লারার বাড়ি কিন্তু ত্রিনিদাদে।
ওশেনিয়া
ওশেনিয়ার সাতটি দেশেও ভিসামুক্ত কিংবা অন অ্যারাইভাল ভিসায় ঘুরে আসার সুযোগ পান বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা। এগুলো হলো কুক আইল্যান্ড, ফিজি, মাইক্রোনেশিয়া, নিউ, সামোয়া, ট্যুভালু আর ভানুয়াতু। এ সব দেশও বিখ্যাত বৈচিত্র্যময় সব সাগরসৈকতের জন্য।
লিস্টিতে ওপরের দিকে রাখতে পারেন ভানুয়াতুকে। বলা চলে রোমাঞ্চকর বাঞ্জি লাফ এসেছে এখান থেকেই। মানে ভানুয়াতু দ্বীপপুঞ্জের এক দ্বীপের বাসিন্দারা শত শত বছর আগ থেকেই এর চেয়ে দুঃসাহসী লাফের কীর্তি করে আসছেন। কাজেই আগে থেকে এ বছর প্রতিযোগিতাটা কখন হবে জেনে হাজির হয়ে যেতে পারেন সেখানে। বুঝবেন বাঞ্জি লাফ আর কী, এর চেয়ে ঢের রোমাঞ্চকর ভানুয়াতুর এই লাফ।
দক্ষিণ আমেরিকা
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের প্রতি আমাদের দেশের ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহ বেশি। তবে এই দুই দেশে নয় বরং এই মহাদেশের একমাত্র বলিভিয়ায়ই অন অ্যারাইভাল ভিসায় ভ্রমণের সুযোগ আছে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে। এই দেশটিতে ভ্রমণ করার মতো জায়গার অভাব নেই।
বিখ্যাত টিটিকাকা হ্রদ, লবণ জমাট বেধে তৈরি হওয়া সমতল সালার দি ওইয়ুনি, পৃথিবীর উচ্চতম রাজধানী লা পাজ, নানা ধরনের উৎসব দেখার ও করার আরও কত কী আছে এখানে।
আফ্রিকা
এই মহাদেশের যে ১৬টি দেশে ভিসামুক্ত বা অন অ্যারাইভাল ভিসায় ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন সেগুলো হলো বুরুন্ডি, ক্যাপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জ, কমোরো দ্বীপপুঞ্জ, গিনি-বিসাউ, লেসেথো, মাদাগাস্কার, মৌরিতানিয়া, মোজাম্বিক, রুয়ান্ডা, সেনেগাল, সিসিলিস, সিয়েরালিওন, সোমালিয়া, গাম্বিয়া, টোগো ও উগান্ডা। এর মধ্যে বিশেষভাবে বলতে হয় মাদাগাস্কারের নাম।
এখানে এমন সব প্রাণী বা উদ্ভিদের দেখা মেলে যা গোটা পৃথিবীতেই খুব একটা দেখা পাওয়া যায় না। সেনেগাল গেলে আবার সেখানকার বিখ্যাত গোলাপি হ্রদ দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। তেমনি বাকি ১৪টি দেশেও দেখার মতো অনেক কিছুই আছে।
১৯৯টি পাসপোর্ট ও ২২৭টি ভ্রমণ গন্তব্যের তথ্যের ভিত্তিতে ১৮ বছর ধরে হেনলি পাসপোর্ট সূচক প্রকাশ করা হচ্ছে। বৈশ্বিক সচলতার পরিমাপে পাসপোর্টের অবস্থান মূল্যায়নে এটাই স্বাধীন রাষ্ট্র ও বিশ্ব নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড। হেনলি পাসপোর্ট সূচকে এবার বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। ২০২২ সালের এই সূচকে অবস্থান ছিল ১০৪তম, যা ২০২৩ সালে হয়েছে ১০০তম। তবে ভিসা ছাড়া ভ্রমণযোগ্য দেশের সংখ্যা এবার একটি কমেছে। কোভিড মহামারীর কারণে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া, সেটা এখনও অব্যাহত আছে।