বাংলাদেশ ক্রমেই একটি গোলোযোগপূর্ণ নির্বাচনী মৌসুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে পরপর দুটি বিতর্কিত নির্বাচনের পর দেশটির জনগণের পাশাপাশি বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত দেশগুলো বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন-পূর্ববর্তী ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে তা অনুমান করার চেষ্টা করছে। আগামী বছরের (২০২৪ সাল) জানুয়ারিতে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এই নিবন্ধে বর্তমান পরিস্থিতির চারটি মূল বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যকল্প উপস্থাপন করা হলো।
প্রথম ভিত্তিঃ আগামী নির্বাচন। আগামী বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের সংবিধানের ধারক-বাহক এবং দেশের গণতান্ত্রিক চর্চার গ্যারান্টার হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। এটা আওয়ামী লীগের অন্যতম শক্তি, একই সঙ্গে দুর্বলতাও বটে।
দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি আওয়ামী লীগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ক্ষেত্র। তাদের কাছে গণতন্ত্র জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সুতরাং আওয়ামী লীগ নির্বাচন আটকে রাখতে পারবে না। লোক দেখানো নির্বাচন হলেও তা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হতে হবে।
দ্বিতীয় ভিত্তিঃ আওয়ামী লীগের বিজয়। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন অত্যন্ত দক্ষ রাজনীতিবিদ। তিনি সশস্ত্র বাহিনী, নিরাপত্তা সংস্থা, আদালত, প্রশাসন, অধিকাংশ মিডিয়া এবং ব্যবসায়ী শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি শক্তিশালী জোট গঠন করেছেন। এই জোট বৃহত্তর অর্থে একটি ক্ষমতাসীন জোট। এই জোট কোনোভাবেই চাইবে না এ সময়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় এসে সরকারি অফিসগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করুক। কয়েক দিন আগে পর্যন্তও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের গতি ছিল ঈর্ষণীয়। দেশটির বর্তমান শাসকদের সম্পর্কে অনেক কিছু বলা যেতে পারে, কিন্তু তারা উন্নয়নের একটি রূপ তৈরিতে তুলনামূলকভাবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অনেকের কাছেই এটি আওয়ামী লীগের সাফল্য বলে প্রতীয়মান।
আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে সেটা মনে করার দ্বিতীয় কারণ হলো, সরকার পরিবর্তন হলে ক্ষমতাসীন দল এবং ক্ষমতাসীন জোটের অনেককেই দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। সে পরিস্থিতি ঠেকাতে তারা যা যা করা দরকার তার সবই করবে। বছরের পর বছর ধরে অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। তারা ধনী হয়েছেন, সমালোচিত হয়েছেন। ক্ষমতা হারালে তাদের অরক্ষিত হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
পুলিশ, আদালত এবং প্রশাসনের অনেকেই নানা সিস্টেমেটিক অপরাধে জড়িয়েছেন। তারা বিরোধীদের হুমকি দিয়েছেন, কারারুদ্ধ করেছেন, হয়রানি করেছেন, তাদের ব্যবসা বা সম্পদ দখল করেছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়, দেশের সব স্তরেই এ ধরনের লোকের অস্তিত্ব রয়েছে। নির্বাচনে পরাজিত হলে তাদের ওপর খড়গ নেমে আসবে। ফলে, তারা প্রতিশোধ থেকে বাঁচতে যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে জিততে চাইবে।
তৃতীয় আরেকটি কারণে আওয়ামী লীগ জিতবে বলে ধারণা করা যেতে পারে, আর তাহলো এর একাধিক শক্তিশালী বন্ধু। দক্ষতার সঙ্গে একটি প্রভাবশালী অভ্যন্তরীণ জোট গঠনের পাশাপাশি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিকভাবেও একটি সমর্থক জোট গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। ভারত, চীন, রাশিয়া এবং আওয়ামী লীগের আরও অনেক সমর্থক দেশ বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখতে নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে মাথা ঘামাবে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরক্ত হবে বটে। তবে এই মুহূর্তে তাদের সামনে আরও উদ্বেগ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে তারা খুব বেশি উদ্বিগ্ন হবে না।
তৃতীয় ভিত্তিঃ বর্তমান সরকারের অধীনে যে কোনো নির্বাচন বিএনপি বয়কট করবে। তারা এটি বারবার বলেছেও। আগের দুটি নির্বাচন (২০১৪ এবং ২০১৮) যেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট কারচুপি হয়েছিল, সেই নির্বাচনের যন্ত্রণাদায়ক শিক্ষা থেকে বিএনপি কোনোভাবেই সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না এবং আওয়ামী লীগেকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
চতুর্থ ভিত্তিঃ সম্পূর্ণ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি জিতবে। এর কারণ এই নয় যে, বিএনপি বিশেষভাবে যোগ্য লোক নিয়ে গঠিত বা বিএনপি সাধারণ ভোটারদের মূল্যবোধ ও ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি মূল রাজনৈতিক দল রয়েছে। আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর অধিকাংশ ভোটার আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতার অহংকারী ও দুর্নীতিবাজ চেহারা দেখে ক্লান্ত। তারা এখন পরিবর্তন চায়। সুতরাং তাদের সামনে একমাত্র বিকল্প বিএনপি।
দৃশ্যকল্প একঃ ক্রমবর্ধমান সহিংসতা
২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে বিএনপি রাজপথে জড়ো হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। ২০১৪ সালে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করা সত্তে¡ও একটি একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সরকার পুরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে এবার বিএনপির সঙ্গে মাঠে নামবে অন্যান্য বিরোধী দলও।
জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামপন্থি দলগুলোও সম্ভবত বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হবে যারা আওয়ামী লীগের আরও পাঁচ বছরের শাসনকে ভয়ের চোখে দেখে। বিরোধীদের বিক্ষোভ সমাবেশ সত্তে¡ও সরকার নির্বাচন আয়োজনের সব প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা নিষেধ করলেও নেতা-কর্মীরা সহিংসতায় জড়িয়ে পড়তে পারে।
রাজপথে বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশের মুখোমুখি হবে। তাদের কারারুদ্ধ করা হবে। তাদের পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তা সংস্থা, আদালত এবং প্রশাসন দ্বারা হয়রানির শিকার হবে। এমনকি কর্তৃপক্ষ বিএনপি সমর্থক শিক্ষক বা ছাত্র-ছাত্রীদের হয়রানি করতে পারে। সরকার বিরোধীদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, লাইসেন্স বাতিল করা হতে পারে এবং তাদের জন্য নতুন ফি ধার্য হতে পারে।
বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে প্রায় বিনা ভোটে আওয়ামী লীগ আরও পাঁচ বছর দেশ শাসন করতে পারবে। কিন্তু এর ফলে ভোটের আগে এবং পরে দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ হবে। সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। বাস পোড়ানো, দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বাড়িতে তৈরি বোমা ও ইট নিক্ষেপের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে।
আওয়ামী লীগ কর্মীরা বন্দুক নিয়ে রাস্তার যুদ্ধে যোগ দিতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং শত প্রতিবাদ সত্তে¡ও ক্ষমতাসীনদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ ধরনের দৃশ্যের সম্ভাবনা ১০ ভাগের ৭ ভাগ।
দৃশ্যকল্প দুইঃ অর্থনৈতিক দুর্দশা
শাসকদের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হলো অর্থনৈতিক মন্দা। বাংলাদেশে এমন একটি গুরুতর অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যার ফলে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগকে আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় দেখতে চাইছে না।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের কথা বলছে। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দায় শুধু দরিদ্ররাই প্রভাবিত হচ্ছেন না, ব্যবসায়ী শ্রেণিসহ মধ্যবিত্তরাও ভ্ক্তুভোগী। ফলে অর্থনৈতিক দুর্দশা সরকারের উন্নয়নের দাবিকে দুর্বল করে তুলছে।
ব্যবসায়ীদের চুপ থাকার জন্য চাপ দেওয়া যেতে পারে এবং কিছু কর্মীকে টাকা দিয়ে কেনা যেতে পারে কিন্তু এ ধরনের কৌশলগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কার্যকর নয়। যারা এতদিন সম্পদ বাড়িয়েছেন তারাও অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ভুগবে। বৈধতা এবং ন্যায্যতা হারানো মধ্যবিত্তরাও যদি রাস্তার প্রতিবাদে শামিল হয় তবে তা সরকারের জন্য এক বিরাট ঝুঁকি তৈরি করবে। বিশ্বজুড়ে দীর্ঘ সময় ধরে দেশ শাসন করা সরকারগুলো মধ্যবিত্ত বিক্ষোভকারীদের কাছে হঠাৎ করে হেরে যাওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে।
আরিল্ড এঙ্গেলসেন রুডঃ অধ্যাপক, সাউথ এশিয়া স্টাডিজ বিভাগ, অসলো ইউনিভার্সিটি, নরওয়ে
ভাষান্তরঃ মুজাহিদুল ইসলাম