নতুন ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানির ওপর আরও শুল্ক বাড়াতে পারে এমন আশঙ্কায় চীনা উদ্যোক্তারা কারখানা স্থানান্তর, যৌথ উদ্যোগ ও নতুন বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাছে ক্রমাগত খোঁজ নিচ্ছেন।
২০২৬ সালে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স নির্দেশনার বিষয়েও চীনারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
এই নির্দেশনার লক্ষ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে টেকসই ও দায়িত্বশীল কর্পোরেট আচরণকে উত্সাহিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ, স্থায়িত্ব ও কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
গত কয়েক মাস ধরে মূলত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সুতা, বস্ত্র এবং তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগ নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতা ও কর্মকর্তারা বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময় বেইজিং থেকে বিনিয়োগের বিষয়ে এমন অনুসন্ধান হয়েছিল। তবে, ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনায় করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক মন্দা যুক্ত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশে এক দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬২৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিনিয়োগ কমে হয় মাত্র ৯১ মিলিয়ন ডলার।
২০২০-২১ অর্থবছরে চীন ৪০৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পর তা আরও বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে ১৮৭ মিলিয়ন ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৬০ মিলিয়ন ডলার হয়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের গড়ে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। চীনাদের দিতে হয় ২৫ শতাংশ।
এ ছাড়াও, বাংলাদেশ বর্তমানে চীনে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো এ দেশ থেকে পণ্য নিয়ে নিজ দেশে সস্তায় বিক্রি করতে পারছে।
যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে। দেশটিতে চীনা পণ্য বিক্রি প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত ৫ নভেম্বর নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি বিজয়ী হলে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবেন।
ট্রাম্প তার আগের মেয়াদে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক প্রায় তিন শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছিলেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হয়।
চীনা পণ্যের ওপর ওয়াশিংটনের উচ্চ শুল্কের কারণে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক বিক্রি বেড়েছে। কমেছে চীনের পণ্য বিক্রি।
পাঁচ বছর আগে পোশাকের বিশ্ববাজারে চীনের অংশ ছিল ৩৬ শতাংশের বেশি। এখন তা ৩১ শতাংশ।
গত পাঁচ বছরে বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে বাংলাদেশের হিস্যা পাঁচ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় আট শতাংশ হয়েছে। বিশ্ববাজারে চীনের পর দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বর্তমানে ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন সনদ পাওয়া পোশাক কারখানার সংখ্যা ২৩০টি। পরিবেশবান্ধব কারখানার হিসাবে এটিই সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদ্য বিদায়ী সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটি দেশ ও পোশাক খাতের সুনাম বাড়িয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চীন ও তাইওয়ান থেকে কয়েক মাস ধরে কারখানা স্থানান্তর ও বিনিয়োগের বিষয়ে প্রচুর খোঁজ আসছে। কারণ তারা ইতোমধ্যে ২৫ শতাংশ শুল্কের চাপে আছে।’
‘এটা ভালো লক্ষণ। তবে যে বিনিয়োগ আসছে তার বেশিরভাগই বাংলাদেশের রুগ্ন পোশাক কারখানা কেনায় খরচ হচ্ছে।’
তার মতে, চীনা বিনিয়োগকারীরা রুগ্ন কারখানাগুলো কিনে নিলেও হঠাৎ করে রপ্তানি বাড়বে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডেইলি স্টারকে জানায়, গত কয়েক মাসে চীনের কয়েকটি চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা করতে বা নতুন বিনিয়োগের জন্য যোগাযোগ করেছে।
বিশ্লেষকদের ভাষ্য, চীনা রপ্তানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্রে বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। আগামী জানুয়ারিতে ট্রাম্পের সরকার গঠনের পর চীনের রপ্তানিকারকরা আরও সমস্যায় পড়বেন।
তবে চীনের যৌথ উদ্যোগ বা নতুন বিনিয়োগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ায় চীনা বিনিয়োগকারীরা খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।’
তিনি জানান, প্রায় দিনই চীনা বিনিয়োগকারীরা যোগাযোগ করে কারখানা স্থানান্তরের বিষয়ে জানছেন।
তার ভাষ্য, চীনা বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। কারণ তাদেরও ইইউর কঠোর শর্তের মুখে পড়তে হবে। পরে এটি বাংলাদেশেও কার্যকর হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিনিয়োগ বিষয়ে চীনাদের খোঁজ-খবর এখনো আগের মতোই আছে।’
‘তবে এটাও সত্য যে, সরকার পরিবর্তন হলেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হয় না।’
তার মতে, ট্রাম্প যেহেতু এখনো দায়িত্ব নেননি, তাই বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের প্রকৃত চিত্র অন্তত এক মাস পরেই পাওয়া যেতে পারে।
একই মত পোষণ করে বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সভাপতি মোহাম্মদ খোরশেদ আলম বলেন, ‘ট্রাম্পের বিজয়ের কারণে চীনের কারখানা স্থানান্তর বা বিনিয়োগের বিষয়ে অনুসন্ধানের প্রকৃত চিত্র পেতে আরও পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগবে।’
বর্তমানে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের গতি ধীর। তারা এ দেশের ব্যবসা-বিনিয়োগের পরিবেশ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।