লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো টাইলস দিয়ে গ্রিক স্থাপত্যশিল্পের আদলে নির্মিত সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স। সৌধের কারুকার্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বেদনার চিত্র। সাদা পাথরে নির্মিত গোলাকার এক গম্বুজবিশিষ্ট সমাধিসৌধের ওপর দেয়ালে জাফরি কাটা। জাফরি কাটা দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করে। ওপরে কাচের কারুকাজ দিয়েও বিভিন্ন আঙ্গিকে বাইরের আলো ছড়িয়ে পড়ে কবরের বিভিন্ন স্থানে।
সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের আশপাশের এলাকায় আরো অনেক কিছু দেখার রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদি পৈতৃক বাড়ি, ছেলেবেলার খেলার মাঠ, প্রিয় বালিশা আমগাছ, বড়তালাব (পুকুর) শেখবাড়ি জামে মসজিদ (স্থাপিত ১৮৫৪ সালে) ইত্যাদি। আছে হিজলতলা ঘাট, যেখানে বঙ্গবন্ধু ছোটবেলায় গোসল করতেন ও সাঁতার কাটতেন।
কমপ্লেক্সের দক্ষিণ দিকে মূল ফটকের (১ নম্বর গেট) কাছে রয়েছে একটি পাঠাগার ও জাদুঘর। পাঠাগারে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বইসহ প্রায় আট হাজার বই রয়েছে। রয়েছে গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনীকেন্দ্র, উন্মুক্ত মঞ্চ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া, মসজিদ, বকুলতলা চত্বর ও স্যুভেনির কর্নার। সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স থেকে ৩০০ মিটার দূরে সাবেক খাদ্যগুদামের পাশে বাইগার নদীর তীরে ও দুই কিলোমিটার দূরে পাটগাতী বাজারসংলগ্ন মধুমতী নদীর তীরে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত দৃষ্টিনন্দন দুটি লঞ্চঘাট। সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের পাশেই টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার উদ্যোগে নির্মিত শেখ রাসেল শিশু পার্ক।
প্রদর্শনীকেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের আলোকচিত্র, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা শিল্পকর্ম, মুক্তিসংগ্রামের নানা পর্যায়ের দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে যে কফিনে করে ঢাকা থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেটিও সংরক্ষিত এখানে। কমপ্লেক্স এলাকায় দর্শনার্থীরা বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও ত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারে।
দর্শনের সময়
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স এবং সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পাঠাগার খোলা থাকে।
পদ্মা সেতুর প্রভাব
গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সেতুটি দিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়েছে। গত দুই বছরে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। প্রতিদিন পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার বঙ্গবন্ধুপ্রেমী, দর্শনার্থী আসে। শীতকালে এই সংখ্যা আরো বেশি হয়।
দর্শনার্থীদের কথা
রংপুর থেকে আসা দর্শনার্থী মো. বেল্লাল হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে দল বেঁধে পরিবার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে ও দেখতে এসেছি। এবারই প্রথম বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে আসা আমার।’
নরসিংদী থেকে আসা মো. সাজেদুল ইসলাম, আরিফ হোসেন, শেফালী বেগম বলেন, ‘গাড়ি ভাড়া করে পরিবার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে এসেছি। সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখলাম, খুবই ভালো লাগল।’
বিক্রি বেড়েছে
দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় টুঙ্গিপাড়ায় হোটেল-রেস্তোরাঁ ও দোকানে বেচাকেনাও বেড়েছে। ভ্যান, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন পরিবহনের চালকদের আয় বেড়েছে। এতে টুঙ্গিপাড়ার অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ এলাকার মিনহাজ স্টোরের মালিক কাজী মিরাজ বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর আমাদের কেনাবেচা অনেক বেড়েছে।’ টি স্টলের মালিক মো. টিটু মোল্লা বলেন, ‘আগে সারা দিনে হাজার টাকা বিক্রি হতো। এখন বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। মাঝেমধ্যে খুবই টাফ হয়। ক্রেতাদের মালপত্র দিতেই ব্যস্ত থাকতে হয়।’
মুদি দোকানি আব্দুর রহিম শেখ বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর আমার বেচাবিক্রি ভালো হচ্ছে। সারা বছর এমন আয় থাকলে আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ ভালো থাকতে পারব।’
ভ্যানচালক শহীদ শেখ, আফজাল হোসেন, পাভেল শেখ এবং অটোরিকশাচালক হাসান আলী ও দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর টুঙ্গিপাড়ায় মানুষ আসা বেড়ে গেছে। সারা দিনই পাটগাতী থেকে টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত যাত্রীর চাপ থাকে। দর্শনার্থীরা আবার ঘুরে ঘুরে সবখানে যায়। আগে প্রতিদিন তাঁরা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে আয় করতেন। এখন আয় হয় এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা করে।
রেস্টুরেন্ট মালিক কবির উদ্দিন বলেন, এখানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা আগের থেকে বেড়েছে। প্রতিদিনই বিক্রি বাড়ছে। আগের তুলনায় আয় বেশি হচ্ছে।
জনপ্রতিনিধির কথা
টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার মেয়র শেখ তোজাম্মেল হক টুটুল বলেন, ‘প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়াও অনেকে বনভোজন ও শিক্ষা সফরে আসে টুঙ্গিপাড়ায়। এত গরমের মধ্যেও প্রতিদিন পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার দর্শনার্থী আসে সমাধিতে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আগমনে মুখর হয়ে ওঠে টুঙ্গিপাড়া। শুক্র ও শনিবার দর্শনার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বহুগুণ। বর্তমানে নিরাপত্তাসহ সব বিষয় দেখভাল করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর শীত মৌসুমে এত কমসংখ্যক লোকবল দিয়ে পরিস্থিতি সামলানো কষ্টসাধ্য।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার সমাধিকে ঘিরে টুঙ্গিপাড়াকে উন্নত মানের পর্যটন এলাকায় রূপান্তর করতে এরই মধ্যে পর্যটন করপোরেশন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখানে শিক্ষা সফরে এসে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পারছে। যে নেতার আহ্বানে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা, তাঁকে এবং তাঁর স্মৃতিকে ঘিরে ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ দেখে মন ভরে ওঠে। অনেকের পাঠ্য বইয়ের সুবাদে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানা ছিল। এখানে এসে তাদের জানা সম্পূর্ণ হয়। ছোট-বড় সবার প্রিয় বঙ্গবন্ধু।’
আবাসন
টুঙ্গিপাড়ায় দর্শনার্থীদের থাকার তেমন ব্যবস্থা নেই। শহরে একটি পর্যটন হোটেল করেছে পর্যটন করপোরেশন। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। দর্শনার্থীদের জন্য ভালো আবাসনের ব্যবস্থা করা গেলে পর্যটন আরো বিস্তৃত হবে। আরো মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
গোপালগঞ্জ উদীচীর সভাপতি নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ায় বেড়াতে বা ঘুরতে আসা অনেকেই বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে মানসম্পন্ন খাবার হোটেল ও পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকা। এসব কিছুর সমাধান হলে টুঙ্গিপাড়া একটি ভালো পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠবে।’
প্রশাসনের কথা
জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম বলেন, জাতির জনকের সমাধিকে ঘিরে প্রতিদিন পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। পদ্মা সেতু চালুর পর এই সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় বেশি দর্শনার্থী আসছে। পর্যটন কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিত পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে এখানকার চিত্র বদলে যাবে। পর্যটকের সংখ্যা আরো বাড়বে। ফলে তৈরি হবে কর্মসংস্থান, বাড়বে পর্যটন ব্যবসার পরিধি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধুর কবরকে ঘিরে সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তখনকার রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ৩৮.৩০ একর জমির ওপর ১৭ কোটি ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সহযোগিতায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সমাধিসৌধের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে।
উল্লেখ্য, একসময় টুঙ্গিপাড়া গ্রামটি পাটগাতী ইউনিয়ন পরিষদের আওতাধীন ছিল। এখন টুঙ্গিপাড়া পৌরসভা ও উপজেলা সদর। টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকায় ঘাতকের বুলেটে তিনি সপরিবারে শহীদ হন।