শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩৭ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

ফারাওর দেশে

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০২২

মিশর বলতেই দুটো কথা মনে পড়ে। পৃথিবীর সপ্তম আর্শ্চযের একটি, পিরমিড ও ইতিহাসে পড়া পাচঁ হাজার বছর পুরনো, নীলনদের উপকলে গড়ে ওঠা মিশরের সভ্যতা। তবে ইতিহাসের হাতছানি যতই থাক, মিশর পর্যটকদের জন্য খুব একটা নিরাপদ জায়গা নয়, এমন ধারণা অনেকেরই। এমনকি, আমরা যাওয়ার কিছুদিন আগেই সেখানের একটি চার্চে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হয়। তবে এই সমস্ত ঘটনার কোনওটাই টুরিস্ট স্পটগুলোতে ঘটে না। টুরিস্ট স্পটগুলোতে রাস্তা ভর্তি এত মিলিটারি, যে মাঝে মাঝে ভয়েই লাগে! আমাদের কায়রো যাওয়া আমার এক বন্ধর আমন্ত্রণে। সে-ই বলেছিল, ভয়ের কিছুই নেই।

ভাগ্যিস তার কথায় বিশ্বাস করে চলে গিয়েছিলাম ফারাওয়ের দেশে! কায়রো আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে যখন নামলাম, তখন আমি, আমার স্ত্রী আর আমাদের ছ’বছরের মেয়ে একই রকম এক্সাইডেট! শহরের ব্যস্ত রাস্তার ভিড় কাটিয়ে গাড়ি করে রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে।

চারদিকে গাড়ির আওয়াজের সঙ্গে মিশে আজানের ডাক, আর জেব্রা ক্রসিং না-মানা- মানুষের ভিড়। মনে হল যেন দিল্লিতেই রয়েছি! তফাত শুধু একটাই এখানের রাস্তায় ঘুড়ে বেড়াচ্ছে প্রচুর গাধা। অবশেষে সন্ধেয় হোটেলে পৌঁছে সেদিনের মতো বিশ্রাম।

পরের দিন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ‘সেভেন ওয়ান্ডার্স অফ দ্য এনশিয়েন্ট ওয়ার্ল্ড’- এর সবচেয়ে প্রাচীন এবং একমাত্র অবশিষ্ট ‘ওয়ন্ডার- গিজার পিরামিড। গাড়ি করে রওনা দেওয়ার আগে আমরা আমাদের কারেন্সি বদলে নিলাম ইজিপশিয়ান পাউন্ডে। আজকের যাত্রায় আমাদের সঙ্গে রয়েছে আমাদের গাইড। এই টুরে সঙ্গে একজন গাইডকে অবশ্যই নেবেন। না হলে ওই অন্তহীন মরুভ‚মিতে অসংখ্য পাথরের স্ত‚পের মাঝে পথ হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা প্রবল। স্থানীয় হকার এবং উটচালকদের অযাচিত ডাকাডাকির হাত থেকে বাচিঁয়ে আমাদের গাইড এনে দাঁড় করালেন গ্রেট পিরামিড অফ গিজার সামনে।

তিনটি পিরামিডের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এটাই। ফারাও খুফুর নামে একে পিরামিড অফ খুফুও বলা হয়। প্রথম দর্শনেই থমকে যেতে হয় এর বিশালতা দেখে। প্রায় ৫০০০ বছর আগে কিছু মানুষ কীভাবে বানিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন ১৪৬.৫ মিটার উচুঁ একটা পিরামিড? এরপরের দ্রষ্টব্য ছিল সেখানকার দ্বিতীয় সবচেয়ে বিখ্যাত পিরামিড, খুফুর ছেলের তৈরি পিরামিড অফ খেফ্রে। উল্লেখযোগ্য বিষয়, সব’কটি পিরামিডই নীলনদের পশ্চিম উপক‚লে তৈরি। প্রাচীন মিশরীয়দের মতে, সূর্য অস্ত যাওয়ার দিকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে মৃত আত্মার। এখানে ভুল ধারণা ভেঙে দিয়ে বলি, পিরামিডের ভিতরে

কিন্তু মমি থাকত না। পিরামিডগুলো পুরোই পাথরের তৈরি, কোনও ঘর নেই ভিতরে। ঘর থাকত পিরামিডের তলায়, তবে সেখানে মৃত রাজার জিনিসপত্র রাখা হত। যে সময়ে পিরামিড তৈরি হয়েছে, তখনও মমি তৈরি আবিষ্কারই করেনি মিশরিয়রা।

গিজায় এসে আরও একটা জিনিস দেখতেই হবে- দ্য গ্রেট স্ফিংস। এর শরীরটা সিংহের এবং মাথাটা ফারাও খেফ্রের। গিজায় লাঞ্চ সারার পর আমরা এবার রওনা দিলাম কায়রোর ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে। ফারাওদের ব্যবহ্যত জিনিস, মূর্তি, গয়না থেকে মমি, কী নেই সেখানে! তবে মমি রাখার বিশেষ চেম্বারের ভিতর ছবি তোলা নিষেধ।

তৃতীয় দিনটা আমরা রেখেছিলাম শহরটা ঘুওে দেখার জন্য। আমাদের প্রথম গন্তব্য, সিটাডেল অফ কায়রো। সেখানে গেলে দেখতে পাবেন মুহাম্মাদ আলির অ্যালাব্যাস্টার মসজিদও। সিটাডেলের উপর থেকে দেখা যায় কায়রো শহরের অসাধারন ভিউ। আমাদেও পরের স্টপ, কপটিক কায়রো।

এটি পুরনো কায়রোর একটি অংশ। এখানে রয়েছে ব্যাবিলন ফর্ট্রেস, কপটি বা মিউজিয়ম, দ্য হ্যাঙ্গিং চার্চ, দ্য গ্রিক
চার্চ অফ সেন্ট জর্জ এবং আরও বেশ কয়েকটি কপটিক চার্চ। বলা হয়, ছোট্ট যিশুখ্রিষ্টকে নিয়ে তাঁর পরিবার এক সময় থাকতেন এখানে। এখানকার এল মোয়েজ ষ্ট্রিটে গিয়ে খোঁজ পেলাম বেশ জমজমাট একটা বাজারের। দরদাম করতে পারলে সুভেনির কেনার আদর্শ জায়গা এই বাজার। দিনটা ছিল বছরের শেষ দিন, তাই ডিনারটা তো স্পেশ্যাল হতেই হবে! আমার বন্ধু আমাদের নিয়ে গেলেন কোশারি আবু তারেক রেস্তোরাঁয়, সেখানে পাওয়া যায় একেবারে অথেনটিক মিশরীয় খাবার। এই রেস্তোরাঁয় গেলে এঁদের বিখ্যাত কোশারি অবশ্যই খাবেন। এছাড়া রসনাতৃপ্তির জন্য আদর্শ হাওয়াওশি, ফাতেহা, সায়াদেয়া ও বেসারাহর মতো স্থানীয় খাবার। নতুন বছরের প্রথম ভোরে আমরা কায়রো থেকে ফ্লাইটে চলে এলাম আরও দক্ষিণে, আসওয়ানে। উদ্দেশ্য, নীলনদের বুকে তিনরাতের ক্রুজ। মোটরশিপে লাঞ্চ সেরে নিয়ে শুরু হল আমাদেও ফেলুক্কা রাইড।

বোটানিকাল গার্ডেন, মুসোলিয়ম অফ আগা খান ইত্যাদি দেখতে দেখতে চলল আমাদের নৌকোবিহার। আশপাশে চলছে আরও বিভিন্ন মাপ ও আকারের নৌকা, কোনওটা মাছ ধরার, কোনওটা মালবাহী, কোনওটা স্থানীয়দের ফেরি, কোনওটা আবার
লাক্সারি ক্রুজ। হাজার হাজার বছর ধওে বদলায়নি নীলনদের বুকে এইভাবে নৌকা চলা। সন্ধেবেলা আমরা ফিরে এলাম আমাদের ক্রুজ শিপে।

এবার যাব কোম ওমবো। এটি একটি জোড়া মন্দির, দু’জন দেবতার উদ্দেশ্যে বানানো । দক্ষিনের মন্দিরটি কুমির দেবতা সোবেকের, তিনি উর্বরতা ও পৃথিবীর সৃষ্টির দেবতা। বাজপাখি দেবতা হ্যারোরিস রয়েছেন উত্তরের মন্দিরে। আগেই বলেছিলাম, পিরামিডের ভিতর মমি থাকতো না। মমিগুলো ছিল এই আসওয়ানের কাছে, পাহাড় কেটে গুহা বানিয়ে তার ভিতরে। এগুলোকে টুম্ব বলে। এখনও পর্যন্ত ৬৩ টি এমন টুম্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এখানকার ভ্যালি অফ কিংসে মিশরের নিউ কিংডমের ফারাওদের মমিগুলো একসময় গোপনে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। মিশরিয়দের কাছে এই ভ্যালি খুবই পবিত্র। টুম্ব ঢোকার মুখে দেওয়ালে দেখা যায় ‘বুক অফ দ্য ডেড’- এর থেকে নেওয়া নানা রঙের লেখা এবং ছবি আঁকা। আমরা এখন অবধি যা যা
দেখেছি তার চেয়ে এবার বেশ অন্যরকম লাগল হাটশেপসুট মন্দির। এ আয়তকার থামের জন্য মন্দিরটিকে বেশ মর্ডান দেখতে লাগে। অর্ধগোলাকৃতি মন্দিরটিও কিছুটা বানানো সেই পাথর কেটেই।

মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের পঞ্চম ফারাও রানি হাটশেপসুটের উদ্দেশে বানানো এই মন্দির। রানির দৈব জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর জীবনের নানা কাহিনি আঁকা রয়েছে মন্দিরের দেওয়ালে। নীলনদেও প্রথম রাতে ছিল পূর্ণিমা। রাতের অন্ধকারে সে এক স্বপ্নরাজ্য হয়ে উঠেছিল! আমাদেও পরের গন্তব্য কারনাক মন্দির। এর ওরিজিনাল নাম ‘ইপেট-সু-এর অর্থ ‘সবচেয়ে সন্মাননীয় স্থান’। মন্দিরে ঢোকার মুখে অভ্যর্থনা জানায় দু’দিকের র‌্যাম-হেডেড স্ফিংসের সারি। কারনাক সবচেয়ে বৃহত্তম ও সবচেয়ে র্দীঘ সময় ধরে অ্যাক্টিভ থাকা মন্দিরগুলোর অন্যতম। আমুন, মুট ও খোনসু নামক দেবতাকে সমর্পন করা এই মন্দির ।

খুটিঁয়ে দেখলে সিলিংয়ে এখনও অক্ষত অবস্থায় দেখতে পাবেন সেই প্রাচীন যুগের কিছু রং। মন্দিরের মূল গৃহটি ছাড়াও রয়েছে
ছোট কিছু মন্দির ও বড় একটি পবিত্র লেক। কারনাক থেকে আমরা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম লাক্সার মন্দিরের দিকে, এটাই আমাদের এই গ্র্যান্ড টুরের শেষ স্পট। একসময় কারনাক থেকে লাক্সার মন্দির পর্যন্ত স্ফিংসের মূর্তি সাজানো একটি রাস্তা ছিল। দ্বাদশ রাজবংশের রাজত্বকালে লাক্সার, দ্য সিটি অফ হান্ড্রেড গেঁস, ছিল মিশরের রাজধানী। সেই তখন থেকে এখনও ব্যবহ্যত হচ্ছে মন্দিরটি। খ্রিষ্ট যুগে মন্দিরের হাইপোস্টাইল হলটিকে চার্চ বানিয়ে ফেলা হয়েছিল।

পরে সেটার উপরই তৈরি করা হয় সুফি শেখ ইউসুফ আবু আল-হাজাজের মসজিদ। মিশর যেন সত্যিই রূপকথার গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা এক ম্যাজিকাল ল্যান্ড! ফারাওদেও রাজত্ব,অসামান্য দেকতার,বিশালাকার পিরামিড, অপূর্ব সুন্দর মন্দির সেগুলো যেমন রহস্যময়, তেমনই চার্মিং। এবার ফেরার পালা। ইজিপ্ট, দ্য ল্যান্ড অফ ম্যাজিককে বিদায় জানিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com