পুণ্যভূমি জেরুজালেম ভ্রমণ করার পর মনে হচ্ছিল, আমি আসল ফিলিস্তিনের দেখা এখনো পাইনি। কারণ, জেরুজালেম একটি মিশ্র শহর, যেখানে অনেক ধর্মের মানুষ বসবাস করে। শহরটি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টান সবার কাছে পবিত্র। তাই শহরজুড়ে দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটক। স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের জীবন কেমন, সেটা স্বচক্ষে দেখা ও অনুভবের জন্য ওয়েস্ট ব্যাংক বা পশ্চিম তীরে প্রবেশ করা ছাড়া আমার হাতে কোনো বিকল্প ছিল না।
ওয়েস্ট ব্যাংকের রাজধানী রামাল্লা। সেখানেই ছিল ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলওর প্রধান কার্যালয়। ফিলিস্তিনের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে পিএলও এবং হামাস। হামাসের কার্যালয় গাজায়। রামাল্লা ছাড়াও ফিলিস্তিনের বাকি গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো হচ্ছে নাবলুস, হিব্রোন ও বেথলেহেম। নাবলুস ছাড়া বাকি সব শহরেই আমি গিয়েছি।
এই চারটি শহরের মধ্যে পশ্চিমাদের কাছে যিশুর জন্মভূমি বলে বেথলেহেম বেশি পরিচিত। এ শহরে যিশুর জন্মস্থানটি বিশেষভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে খ্রিষ্টানদের উপাসনার জন্য। সেখানে আছে চার্চ অব দি নেটিভিটি নামে একটি গির্জা। পশ্চিম থেকে আসা অনেক খ্রিষ্টান বিভিন্ন গ্রুপ ট্যুর করে থাকে এই গির্জায়। সে জন্য আমার মতো একা বেথলেহেম যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য। পশ্চিম তীরকে জেরুজালেম ও ইসরায়েল থেকে আলাদা করার জন্য চতুর্দিকে ইসরায়েলি সরকার এমনভাবে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছে যে স্থানীয় গাইড ছাড়া একাকী চলাচল করাটা খুবই কঠিন।
জেরুজালেম থেকে বেথলেহেম এবং অন্যান্য শহরে যাতায়াতের জন্য নিয়মিত বাস আছে। তবে বাসে যাওয়াটা সহজ হলেও ফিরে আসাটা এত সহজ নয়। কারণ জেরুজালেম জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি নিরপেক্ষ শহর হলেও বর্তমানে এটি ইসরায়েলের দখলে এবং ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে ইসরায়েলের অনুমতি ছাড়া কেউ জেরুজালেমে প্রবেশ করতে পারে না। পশ্চিম তীর উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা এবং কিছুক্ষণ পরপর ইসরায়েলি চেক পয়েন্ট বসানো রয়েছে। সেসব চেক পয়েন্ট দিয়ে ইসরায়েলি সৈন্যদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে জেরুজালেমে প্রবেশ করতে হয়। ফলে ইউরোপিয়ান পাসপোর্টের সুবাদে ৫ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এসে আল-আকসা দেখা গেলেও মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে জন্ম নেওয়া একজন ফিলিস্তিনের পক্ষে সেখানে গিয়ে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়া সম্ভব নয়!
ফিলিস্তিনিদের চোখমুখে পরাধীনতার কষ্ট দেখেছি। বলা হয়ে থাকে, আল-আকসা মসজিদের সব থেকে বড় হকদার ফিলিস্তিনিরা। অথচ পশ্চিম তীর থেকে জেরুজালেমে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসরায়েলের অনেক জায়গায় নিম্ন বেতনে কাজ করে থাকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের লোকজন। এই কাজের জন্য তাদের বিশেষ একটি ওয়ার্কিং পাসের প্রয়োজন হয়। শুধু তারাই জেরুজালেম যেতে পারে, যাদের কাছে আছে ইসরায়েলে কাজ করার সেই বিশেষ ওয়ার্কিং পাস।
পশ্চিম তীরের ভেতরেও এক শহর থেকে আরেক শহরে যাতায়াতে আছে ইসরায়েলি অনেক বাধ্যবাধকতা। ইসরায়েল দেয়াল ও চেক পয়েন্টগুলো এমনভাবে তৈরি করেছে, যাতে মুহূর্তের মধ্যেই তারা এক শহরকে আরেক শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। এ জন্য এক শহর থেকে আরেক শহরের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার হলেও সেখানে যেতে হলে গাড়ি চালাতে হয় ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার।
জেরুজালেম থেকে পশ্চিম তীর যাওয়া-আসার সময় এবং পশ্চিম তীরের ভেতরেও দেখা যায় ইসরায়েলি সেটেলমেন্ট।
জুলুম-নির্যাতন এবং পরাধীনতা ও খাঁচাবন্দী জীবনের মধ্যেও ফিলিস্তিনিরা তাদের জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। বড় বড় শপিং মল হচ্ছে, রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে। আছে ফ্যান্সি কফি শপ, রেস্টুরেন্ট; মানুষ সেখানে আড্ডা দিচ্ছে। রাস্তার মাঝে দামি দামি বিএমডব্লিউ, মার্সিডিস, জাগুয়ার গাড়ি চলাচল করছে। এত কিছুর মধ্যেও জীবন থেমে নেই—জীবন জীবনের মতো চলে যাচ্ছে।
পশ্চিম তীরে আমার ভ্রমণ শেষ করেছিলাম রামাল্লা শহরে ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক নেতা ইয়াসির আরাফাতের কবর ও মিউজিয়াম ভ্রমণের মাধ্যমে। পুরো ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট একটি ধারণা পাওয়া যায় ছোট্ট সুন্দর এ জাদুঘরটিতে গেলে। এ জাদুঘরে ঘোরার সুযোগ হয়েছে আমার খুব অল্প সময়।
পশ্চিম তীর ছেড়ে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার সময় একধরনের মিশ্র অনুভূতি হলো। একদিকে পুরো ওয়েস্ট ব্যাংক দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেখে মনে হয় যেন খোলা আকাশের নিচে বাইরে যাওয়ার সুযোগহীন একটি উন্মুক্ত জেলখানা। অন্য দিকে হাল ছেড়ে না দেওয়া, বেঁচে থাকার উপায় খুঁজতে থাকা, স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখে অনেক মানুষ।