রেকর্ড নেট মাইগ্রেশন-এর পর প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সরকার সোমবার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত অভিবাসীরা এক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় পাবেন৷ কিন্তু তারা তাদের পরিবারকে যুক্তরাজ্যে আনতে পারবেন না৷ যুক্তরাজ্যে আসা কোনো শিক্ষার্থীও তার নির্ভরশীলকে দেশটিতে আনতে পারবেন না৷

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেনের রাজনীতিতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে নিয়মিতভাবে দেশটিতে আসা অভিবাসীরা৷ ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে আসার ক্ষেত্রেও এটি ছিল অন্যতম একটি কারণ৷

আগামী বছর দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন৷ নির্বাচনের আগে জনমত জরিপে বিরোধী লেবার পার্টির তুলনায় পিছিয়ে আছেন ক্ষমতাসীনেরা৷ এর মধ্যে দেশটিতে নেট মাইগ্রেশন (ব্রিটেন ছেড়ে যাওয়া ও ব্রিটেনে আসা মানুষের মধ্যে পার্থক্য) রেকর্ড পর্যায়ে উন্নীত হওয়ায় নিজ দলের আইনপ্রণেতাদের তোপের মুখে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক৷ ফলে, পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সুনাক৷

প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কার্যালয় এসব প্রস্তাবকে ‘এখন পর্যন্ত আইনি অভিবাসনের সবচেয়ে বড় বাধা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন৷ কিন্তু সমালোচকেরা বলেছেন, এর ফলে কর্মী ঘাটতিতে থাকা রাষ্ট্রচালিত ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ সরকারের নতুন এই ঘোষণার সমালোচনা করেছেন বাণিজ্য ও ট্রেড ইউনিয়নগুলো৷

গত মাসে সরকারি এক পরিসংখ্যান দেখা গেছে, ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের বার্ষিক নেট মাইগ্রেশন সাত লাখ ৪৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে৷ এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবর্তে ভারত, নাইজেরিয়া এবং চীনের মতো দেশ থেকে অভিবাসীরা আসছেন৷

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেছেন, সরকারের নেয়া নতুন পদক্ষেপ নেট মাইগ্রেশনকে তিন লাখে নামিয়ে আনতে পারে৷

যুক্তরাজ্যে অনিয়মিত পথে আসা অভিবাসীদের রুয়ান্ডায় স্থানান্তরের চেষ্টারত সরকারপ্রধান ঋষি সুনাক বলেন, ‘‘অভিবাসনের মাত্রা খুব বেশি৷ এটিকে নামিয়ে আনার জন্য আজকে আমরা আমূল পদক্ষেপ নিচ্ছি৷’’

ক্লেভারলি বলেছেন, পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্য থাকতে হলে বিদেশী দক্ষ কর্মীদের ন্যূনতম বেতন ২৬ হাজার ২০০ পাউন্ড থেকে বাড়িয়ে ৩৮ হাজার ৭০০ পাউন্ডে নিয়ে যেতে চায় সরকার৷

অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে, বিদেশি স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের পরিবারের সদস্যদের আনতে পারবেন না, যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্যসেবা নিতে অভিবাসীদের সারচার্জের পরিমাণ বাড়ানো৷

ব্রেক্সিটের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকদের অবাধ যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমবাজারে ঘাটতি মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ীদের৷ এর মধ্যে সরকারের এমন পদক্ষেপে সেই সংকট আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে৷

অক্টোবরে সরকারের ইনডিপেনডেন্ট মাইগ্রেশন অ্যাডভাইজর শ্রমঘাটতির তালিকাটি বাতিলের সুপারিশ করেছিলেন৷ অথচ এটি ছিল গুরুতর কর্মী ঘাটতি রয়েছে এমন খাতে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগে অন্যতম একটি পথ৷

আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লেভারলি বলেন, ‘‘আমরা ব্রিটিশ কর্মীদের বেতন কমিয়ে অভিবাসন বন্ধ করব৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা কমসংখ্যক পেশাসহ একটি নতুন অভিবাসন বেতন তালিকা তৈরি করব৷’’

বাণিজ্যিক সংস্থা ইউকে হসপিটালিটির প্রধান নির্বাহী কেট নিকোলস বলেছেন, ‘‘এই পরিবর্তনগুলো ট্যালেন্ট পুলকে আরো সংকুচিত করবে, সেবাকেন্দ্রিক বাণিজ্যগুলো আরো ক্ষতির মুখে পড়বে৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের জরুরিভাবে একটি অভিবাসন ব্যবস্থা প্রয়োজন যা বাণিজ্যের প্রসার এবং শ্রমঘাটতি দূর করতে কাজে আসবে৷ বর্তমান ব্যবস্থাটি প্রয়োজন মেটাতে পারছে না৷’’

ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ড গত মাসে বলেছে, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োগপ্রক্রিয়াকে সহজ করার চেষ্টা করছে এবং কিছু খাতে দক্ষতার ঘাটতি রয়ে গেছে৷

এদিকে ট্রেড ইউনিয়নগুলোও ক্লেভারলির পরিকল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ ইউনিসন-এর জেনারেল সেক্রেটারি ক্রিস্টিনা ম্যাকআনিয়া বলেন, এসব সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য পরিষেবায় ‘সম্পূর্ণ বিপর্যয়’ এর ইঙ্গিত দিচ্ছে৷

তিনি বলেন, ‘‘অভিবাসীরা এখানে তাদের পরিবার ছাড়া বাঁচতে বাধ্য হওয়ার বদলে যেখানে তাদের স্বাগত জানাবে সেখানে চলে যাবেন৷’’

ছোট ছোটো নৌকায নিয়ে উত্তর ফ্রান্স থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসা অনিয়মিত অভিবাসীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও বেগ পোহাতে হচ্ছে সুনাক সরকারকে৷ অথচ, ইংলিশ চ্যানেলে অভিবাসীবাহী নৌকা ঠেকানো ছিল তার প্রধান অঙ্গীকারের একটি৷

চলতি বছর চ্যানেল পাড়ি দিয়ে অন্তত ৩০ হাজার অভিবাসী এসেছেন যুক্তরাজ্যে৷

সরকার চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসাকে ‘বেআইনি’ বলে আখ্যা দিয়েছ৷ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিরুৎসাহিত করতে আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় স্থানান্তরে চুক্তিও করেছিল দেশটি৷ অনেক আইনি লড়াইয়ের পর নভেম্বরে সরকারের সিদ্ধান্তটিকে বেআইনি বলে রায় দিয়েছে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত৷

তবে, তাতেও অবশ্য দমবার পাত্র নন ঋষি সুনাক৷ রুয়ান্ডায় আশ্রয়প্রার্থী স্থানান্তরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নতুন কৌশল করছেন তিনি ও তার সরকার৷ ফলে, যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি চলতি সপ্তাহে কিগালি সফরে যেতে পারেন৷ কারণ, আগামী বসন্ত থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠাতে চান তারা৷