মার্কিন তেল-গ্যাস কোম্পানির কাছে গ্যাস বিক্রির অনুরোধ করেছিলেন বাংলাদেশ সফরকারী তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। নিজেদের চাহিদা মেটানোর মতো মজুদই না থাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শেখ হাসিনা ও অপরাপর আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে তার মূল্য দিতে হয়। ক্ষমতায় আনা হয় বেগম খালেদা জিয়াকে।
শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো প্রকাশ্যভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে নানাভাবে তৎপরতা চালিয়ে আসছে। ঢাকাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কার্যকলাপ বিএনপি ও তার অনুগামী বিরোধী দলগুলোকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করছে। ফলে ২৮ অক্টোবর সরকারের পতন ঘটানোর কর্মসূচি সফল বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরীক্ষিত পরম বন্ধু নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সরকারের দূরদর্শী প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের সুদক্ষ তৎপরতায় বিপজ্জনক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি হঠাৎ করেই বাংলাদেশ প্রশ্নে তার নীতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে? কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল তা মনে করেন না। তাদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সুদূরপ্রসারী স্বার্থ ও কর্মপরিকল্পনা নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে কৌশল পাল্টাতে পারে মাত্র।
কূটনৈতিক সূত্রমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের পরিকল্পনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেয় না। মহাশক্তিধর চীনকে মোকাবিলায় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র শক্তি। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের মধ্যে ভারতকেই সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক শক্তিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমপর্যায়ে। নৌশক্তিতে চীন আমেরিকার চেয়েও অধিকতর শক্তিশালী। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপানসহ অর্থনৈতিক-সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিধর দেশসমূহের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশ। তার ভৌগোলিক অবস্থান অর্থাৎ ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে। সামরিক-অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক স্বার্থ নিরঙ্কুশ ও নিরাপদ রাখার স্বার্থে ভারত প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চল, বিশেষ করে এই অঞ্চলের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি। তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর ও রাজনৈতিক মেরুকরণের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। সরকারের ওপর নানামুখী চাপ ও প্রভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই মূলত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। মার্কিন এই ভূমিকা ও অবস্থানকে চীন, রাশিয়া একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ওপর হস্তক্ষেপ বলেই মনে করে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।
তারা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, ভৌগোলিক অখণ্ডতার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশকেন্দ্রিক অবস্থানের প্রকাশ্য বৈরী অবস্থান নিয়েছে। অপরদিকে মিয়ানমারকে চীনের কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণের বাইরে আনতে এবং তাদের বিপুল গ্যাস-তেলসম্পদ করায়ত্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারকে দুর্বল করার বহুমুখী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কাজে বাংলাদেশ তার ভূখণ্ড যুক্তরাষ্ট্রকে তার স্বার্থে ব্যবহার করতে দেওয়ার প্রবল বিরোধী।
এতে চীন বাংলাদেশের প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল হয়ে বাংলাদেশের স্বার্থে চীন যেকোনো অবস্থান নিতে কুণ্ঠিত নয় বলে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে। শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ সরকারের শক্তির উৎস একদিকে নিকটতম প্রতিবেশী ভারত, অন্যদিকে অন্যতম মহাশক্তি চীন। তৃতীয় একটি দেশের প্রতি চীন, ভারতের এমন অভিন্ন অবস্থান বিশ্বে এই প্রথম।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীরব কূটনীতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। এ কথা বলেছিলেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানেরা। এখন বাংলাদেশের ব্যাপারেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একধরনের নীরবতা অবলম্বন করছেন। কূটনৈতিক পরিভাষায় একে বলা হচ্ছে সাইলেন্ট ডিপ্লম্যাসি। এই নীরব কূটনীতি যেকোনো দেশের জন্য আতঙ্কের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন কূটনীতিক বিশ্লেষকেরা।
গত দুই বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত সরব অবস্থানে ছিল। তারা বাংলাদেশের ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছিল কোনো রকম রাখঢাক ছাড়াই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হবে এবং এই নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক। স্পষ্টতই সরকারের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক কূটনীতিক গত দুই বছরে বাংলাদেশ সফর করেছেন। সরকার এবং বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসও এই সময় ছিলেন সরব।
গত বছরের ১৫ মার্চ বাংলাদেশে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে পিটার হাস বাংলাদেশের নির্বাচন, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অত্যন্ত সরব এবং ব্যস্ত সময় কাটান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এবারের যে নির্বাচন হচ্ছে, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফর্মুলা অনুযায়ী নয়, এটা সহজেই বলা যায়। কারণ এই নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করছে না। কাজেই মার্কিন সংজ্ঞা অনুযায়ী এটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, একটি নির্বাচনে যদি ৪০ শতাংশ বা তার বেশি ভোটার উপস্থিতি থাকে, তাহলে সেই নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক বলে বিবেচিত হবে। সে জন্যই এবারের নির্বাচন আওয়ামী লীগ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সবগুলো আসনেই ৪-৫ জন স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ প্রার্থী এবার দাঁড়িয়েছেন। ফলে এবার নির্বাচনে কোথাও কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন না। ভোটযুদ্ধ হবে সব আসনেই। তার পরও এই ফর্মুলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুশি কি না, তা এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে এবং এই শ্রমনীতি ঘোষণার সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিক কল্পনা আক্তারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন। এরপর ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো এক বার্তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার কমার্স এই নতুন শ্রমনীতির টার্গেট বাংলাদেশ হতে পারে এবং বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশ শ্রমনীতির টার্গেট হবে না।
কিন্তু বিভিন্ন সূচক বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন, গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনের প্রস্তুতি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা ইত্যাদি বিষয়ের দিকে গভীরভাবে নজর রাখছে এবং এসব নজর রাখার ফলে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা সুস্পষ্ট এবং দৃশ্যমান অবস্থান নির্বাচনের পরপরই স্পষ্ট হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্তুষ্টমূলক না হয়, তাহলে তারা বাংলাদেশের ব্যাপারে অনেক কিছুই করতে পারে এমন শঙ্কার কথাও প্রকাশ করা হচ্ছে বিভিন্ন সময়।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৭ জানুয়ারি। তবে এই নির্বাচনই শেষ কথা নয়এমন গুঞ্জন রয়েছে সুশীল সমাজ এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে। তারা মনে করছেন, এই নির্বাচন হবে সংবিধান রক্ষা এবং আনুষ্ঠানিকতার নির্বাচন। এরপর আসল সমঝোতা হবে এবং একটি নতুন নির্বাচন হবে। সেই নতুন নির্বাচনের মাধ্যমেই চূড়ান্ত ফয়সালা হবে।