শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৫ পূর্বাহ্ন

তিলোত্তমা ঢাকা এখন দূষণের নগরী

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৪

তিলোত্তমা ঢাকা। সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের স্বপ্ন এই নগরীর প্রতিটি বাসিন্দার। তবে এই নগরী দিনকে দিন পরিণত হচ্ছে সমস্যার নগরীতে। ঢাকার পরিবেশের যে বিপর্যয় ঘটছে এতে এই নগরী বসবাসের অযোগ্য শহর হয়ে উঠছে দিনকে দিন।

ঢাকা বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি। ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহর দেশের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্রবিন্দু। ফলে জীবিকা, শিক্ষা এবং চিকিৎসাসহ যে কোনো প্রয়োজনে মানুষ প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এই শহরে। ধারণ ক্ষমতার বেশি মানুষ জায়গা করে দেয়া ঢাকা নগরীর পরিবেশের যে বিপর্যয় দিনকে দিন ঘটছে এতে এই নগরীতে বাস করা তো দূরে থাক শ্বাস নেয়া কষ্টের হয়ে উঠছে।

দ্য ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ‘সেইফ ইনডেক্স বাই সিটি ২০২৩’-এর তথ্যমতে, বিশ্বের বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ঢাকা একদিক থেকে যেমন ধীরে ধীরে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, তেমনি হয়ে উঠছে প্রায় সব দুর্যোগের কেন্দ্রস্থল। ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ হাজার মানুষের বাস। ম্যাক্রোট্রেন্ডসের মেট্রো এরিয়া র‍্যাঙ্কিং-২০২৩ অনুযায়ী, ঢাকা পৃথিবীর চতুর্থ ঘনবসতিপূর্ণ শহর। 

আলোদূষণ, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ থেকে শুরু করে প্রায় সব সমস্যাই গ্রাস করে বসেছে ঢাকাকে। ঢাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষের কাছে প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই চলতে হচ্ছে।

ঢাকার বায়ুদূষণ

বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজুয়ালের তথ্যানুযায়ী, বায়ুমানের সূচক শূন্য থেকে ৫০-এর মধ্যে থাকলে সেটিকে ভালো বা স্বাস্থ্যকর, ৫১ থেকে ১০০ হলে সহনীয়, ১০১ থেকে ১৫০ হলে সংবেদনশীল মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-এর উপরে হলে বিপজ্জনক বলা হয়। এয়ার ভিজুয়ালের তথ্য বায়ুমান অনুযায়ী অধিকাংশ সময়ই ঢাকার বায়ু থাকে অস্বাস্থ্যকর।

বায়ুমানের এমন বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বলছে, রাজধানীতে নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, ইটভাটা, সড়কের নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়াখুঁড়ি, মেগা প্রজেক্টের নির্মাণযজ্ঞ, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পোড়ানো—মূলত এসব মিলে ঢাকা শহরের বাতাস বিপজ্জনক করে তুলেছে।

রাজধানীতে শব্দ-তাণ্ডব

বায়ুদূষণের শীর্ষে থাকা ঢাকা শব্দদূষণেও শীর্ষ অবস্থানেই। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য, যেখানে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দদূষণের মাত্রা তুলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল, যা এ প্রতিবেদনে আসা শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৯৯ সালের গাইডলাইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। এই হিসাবে ঢাকার বাসিন্দাদের পথ চলতে গিয়ে জাতিসংঘের বেঁধে দেয়া সীমার দ্বিগুণ মাত্রার শব্দের অত্যাচার সহ্য করতে হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দদূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়কে যানজটকালে যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, উড়োজাহাজ, ট্রেন, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট শব্দ। শহরে নির্মাণ কাজ, গ্রিল, টাইলস কাটা, মেশিনে ইট ভাঙা, মাইক বাজানো, জেনারেটরের শব্দে কান ঝালাপালা অবস্থা।

রাজধানীর শব্দদূষণ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বলেন, একটি শহরে কিছু সাইলেন্ট জোন থাকে। এগুলো মূলত হাসপাতাল কিংবা স্কুল-কলেজ বা রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। এগুলো যেখানে থাকে, শহরের সেই জায়গাগুলোকে সাইলেন্ট জোন বলা যেতে পারে। সাইলেন্ট জোনে দিনের বেলা স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে ৪৫ ডেসিবল এবং রাতের বেলা ৩৫ ডেসিবল। আপনি যে রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে আছেন, দিনের বেলা সেখানে থাকতে হবে ৫০-এর নিচে এবং রাতের বেলা ৪০-এর নিচে।
২০২০-২১-এর এ-সংক্রান্ত বেশ কিছু গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকা শহরের বেশ কিছু মেইন রোডে যেমন: জাহাঙ্গীর রোড, ফার্মগেট, শ্যামলী প্রত্যেকটিতে দেখা গিয়েছে দিনের বেলা ৭৮ থেকে ১১৯ ডেসিবল থাকছে। যেহেতু এটা একটা মেইন রোড সেহেতু এখানে দিনের বেলা ৬০ ডেসিবল এবং রাতের বেলা ৫০ থাকা উচিত। কিন্তু সেখানে দিনের বেলায় থাকছে ৭৮ থেকে ১২০ ডেসিবল এবং রাতের বেলা থাকছে ৮৯ ডেসিবল।
তিনি বলেন, ‘শব্দদূষণের উৎস হিসেবে কন্ট্রাকশন ওয়ার্ক এবং যানবাহন সৃষ্ট শব্দ যেগুলো মূল উৎস শব্দদূষণের, এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। যেমন, আবাসিক এলাকার ভেতর আমরা ইট ভাঙার মেশিন সাবলীলভাবে ব্যবহার করছি, এমন মেশিন এনে ভবন নির্মাণ কাজ পরিচালনা করা; এগুলো একদমই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া হাইড্রলিক হর্ন রাস্তায়, এটা নিষিদ্ধ। তবু এই নিষিদ্ধ হর্নগুলো বাজারে আসে কীভাবে? এগুলো আমদানি করা হয় কেন? এ ধরনের বিষয়গুলো আমরা দেখি যে, একটা আরেকটার সঙ্গে সমন্বয়হীনতার অভাব।’
‘মিক্সড ল্যান্ড ইউজ কন্ট্রোল করতে হবে। যেখানে আবাসিক সেখানে আবাসিকই থাকবে, সেখানে কলকারখানা থাকবে না। যেখানে ইন্ডাস্ট্রি থাকবে সেখানে আবাসিক থাকবে না। তবে শব্দদূষণ অনেকটাই কন্ট্রোল করা সম্ভব। এ ছাড়া যানবাহনের হর্ন বাজানোর ক্ষেত্রে জরিমানার নীতিমালাকে আরও কঠোর করতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।

ঢাকার আরেক সমস্যা জলাবদ্ধতা

ঢাকার অন্যতম বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে। এ সমস্যা দূর করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও, সেগুলো তেমন ফলপ্রসূ হয়নি বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজেম বলেন, জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে ড্রেনেজ সিস্টেম ভালো করতে হবে। ঢাকার যে ড্রেনেজ সিস্টেম তা অত্যন্ত দুর্বল। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি জমে যায়। অথচ ঢাকা কিন্তু অনেক সুবিধা সমৃদ্ধ একটা শহর, যার চারপাশেই নদী। এ ছাড়া ঢাকায় অনেক খাল ছিল, যা এখন নেই। সেগুলো থাকলে ড্রেনেজ সিস্টেম আরও ভালো হতো। কিন্তু বহু খাল ভরাট করে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে, আবার দখল হয়ে গেছে অনেক খাল। তাই আজ ড্রেনেজ সিস্টেমের এ অবস্থা।

খাল-নদী দখল প্রতিরোধ করা অসম্ভব ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, এটি মোটেও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সবাই নিজের লাভ চেয়েছে। খাল ভরাট করে বাড়ি করেছে, কেউ রাস্তা করেছে। যখন কারো বাড়ি হচ্ছে, কারো রাস্তা হচ্ছে; তখন কেউ আর প্রতিরোধ করার চিন্তা করেনি।

নগরীতে আলোদূষণ

জল, বায়ু এবং শব্দদূষণের মতো আলোদূষণ রাজধানীতে আরেক বড় সমস্যা। কোথাও যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রার আলো থাকে বা কোথাও যদি অপ্রয়োজনীয় আলো থাকে, তাহলে সেটিকেই আলোদূষণ বলে ব্যাখ্যা করেন বিশেষজ্ঞরা। এই দূষণের জন্য মূলত কৃত্রিম আলো দায়ী।
ঢাকায় যত্রতত্র নিয়ম না মেনে সড়কবাতি স্থাপন, ভবনের ভেতরে ও বাইরের অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, সড়কে ছোট-বড় নানা আকারের বিলবোর্ড বসিয়ে তাতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনসহ নানা কারণে আলোদূষণ হচ্ছে। তবে ঠিক কত মাত্রার আলো হলে তা দূষণের পর্যায়ে পড়বে না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। কারণ, কোন স্থানে কতটুকু আলো প্রয়োজন, তা অনেক ধরনের নিয়ামকের ওপর নির্ভর করে। যেমন: স্থানের ধরন, আয়তন, গুরুত্ব ইত্যাদি।

আলোদূষণের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আলোর মাধ্যমে পরিবেশের কোনো অংশে আলোর মাত্রা বা এর গুণগত পরিবর্তন যখন হয় তখন সেটাকে আমরা বলি আলোদূষণ। আলোদূষণ সাধারণত কারিগরি কারণেও হতে পারে। যেমন: বিদ্যুতের ব্যবহার ট্রাফিক পরিবহন, ইলেকট্রনিক উপকরণের ব্যবহার।
এ ছাড়াও সিটিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকেও আলোদূষণ হয়ে থাকে। আলোদূষণের প্রধান প্রভাব হলো যে পরিবেশের মান, জনসম্পদ এবং স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আলোদূষণের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। আমার কাছে মনে হয়, রাস্তার আলোদূষণের মাত্রা ভয়াবহ, যা অনেক দুর্ঘটনারও কারণ। গাড়িতে অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার আলোদূষণকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে ফেলে। গাড়ির লাইটের বাইরেও মানুষ গাড়িতে এত পরিমাণ লাইট ব্যবহার করে, যা কিন্তু রাস্তায় দুর্ঘটনার কারণ।’
এই অধ্যাপকের মতে, আলোদূষণের বিপরীতে কিছু উদ্যোগ নিলেই প্রতিকার সম্ভব। যেমন: বাসায় বা কারখানায় আলোর ব্যবহার কমালে, বিদ্যুতের সঠিক ও প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার, পরিবহন ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা ও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা দূষণ কমাতে পারি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com