শান্ত–নীরব এক দ্বীপ। যত দূর চোখ যায় শুধু নীল জলরাশি। পথে পথে জুঁই ফুলের সৌরভ। ঝাঁ–চকচকে সড়ক। কিন্তু গাড়ি নেই। চারপাশ থেকে ভেসে আসে টগবগ করে ঘোড়ার ছুটে চলার শব্দ।
এজিয়ান সাগরপাড়ের শান্ত দ্বীপটির নাম হাইড্রা। গ্রিসের এ দ্বীপের বিশেষত্ব—সেখানে মোটরযান চলে না। কারণ, গাড়ির শব্দের চেয়ে ছন্দ তুলে ঘোড়ার ছুটে চলাই বেশি পছন্দ দ্বীপের বাসিন্দাদের।
দ্বীপে যে শুধু গাড়ি দেখা যায় না তা–ই নয়, গাড়ি যাতে কেউ আনতে না পারেন, রয়েছে সেই বন্দোবস্তও। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আইন করে সব ধরনের মোটরযানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবে জরুরি সেবা বিবেচনায় শুধু অ্যাম্বুলেন্স ও অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত গাড়ি চলাচলের অনুমতি রয়েছে।
দ্বীপটির বাসিন্দা প্রায় আড়াই হাজার। গাড়ি চলাচল না করায় সেখানে যাতায়াতের প্রধান বাহন ছোট ছোট ঘোড়া। এ ছাড়া খচ্চর নয়তো গাধার পিঠে চড়েও স্থানীয় বাসিন্দাদের চলাচল করতে দেখা যায়।
দ্বীপের প্রাণকেন্দ্র হাইড্রা বন্দর। ফেরি থেকে বন্দরে নামলেই পর্যটকেরা দেখতে পান অভাবনীয় এক দৃশ্য। ফেরিঘাটে সারি সারি ঘোড়া দাঁড়ানো। পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন ঘোড়সওয়ারিরা। পাথুরে সড়কে ঘোড়ায় চেপে গন্তব্যে যাওয়ার সেই অনুভূতি একেবারে অন্যরকম।
হাইড্রার সঙ্গে দুই যুগের সম্পর্ক তরুণ হারিয়েত জারমানের। পর্যটকদের ঘোড়ায় নিয়ে দ্বীপ ঘুরে দেখানোই তাঁর পেশা। হারিয়েত হাইড্রা হর্সেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন তিনি। নিজের নামে গড়া এ প্রতিষ্ঠানের এক ডজন ঘোড়ার মাধ্যমে পর্যটকদের ভ্রমণসেবা দিচ্ছেন তিনি।
হারিয়েত বলেন, হাইড্রা এমন এক দ্বীপ যে আপনাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। এখানে সব ধরনের যোগাযোগ হয় ঘোড়া নয়তো খচ্চরে। কারণ, এখানে গাড়ি নেই। সবাই শান্তিতেই থাকেন।
হাইড্রায় জন্ম এলেনা ভৎসির। কাজের সূত্রে থাকতে হয় এথেন্সে। তবে সুযোগ পেলেই অবসর যাপনে এ দ্বীপে ছুটে আসেন। এলেনা বলেন, ‘হাইড্রার মতো এত আলো এত রঙের খেলা আর কোথাও পাই না। পাথর থেকে সমুদ্রের ঢেউ পর্যন্ত এর সবকিছুই আমাকে দারুণ অনুপ্রেরণা দেয়।’
যুগে যুগে অনেকে দ্বীপটির প্রেমে পড়েছেন, মুগ্ধ হয়েছেন এর অপার সৌন্দর্যে। তেমনই একজন সোফিয়া লরেন। ১৯৫৭ সালে ‘বয় অন আ ডলফিন’ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে এসে দ্বীপটির প্রেমে পড়েছিলেন অস্কারজয়ী প্রখ্যাত এই অভিনেত্রী।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইদ্রা একটি ব্যস্ত সামুদ্রিক কেন্দ্র হিসাবে বিকশিত হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রিসের অন্যান্য দ্বীপগুলোতে মোটরচালিত পরিবহন চালু হয়। তবে ইদ্রার সংকীর্ণ ও খাড়া রাস্তা মোটরগাড়ি চলাচলের উপযুক্ত ছিল না।
তাই স্থানীয়রা যাতায়াতের জন্য ঘোড়া ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এই প্রাণীগুলো দ্বীপের পাহাড়ি উঁচুনিচু পথ দক্ষতার সঙ্গে পাড়ি দিতে সক্ষম।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পরিবহনই দ্বীপের সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের অংশ হয়ে উঠে। পরে মালামাল পরিবহনের জন্য গাধা ও খচ্চরের ব্যবহারও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। দ্বীপের সেই ঐতিহ্য এখনও বহাল আছে।
বিশ্বের অনেক বিখ্যাত শিল্পী এই দ্বীপটি ভ্রমণে এসেছেন অথবা থেকে গেছেন। শিল্পী ব্রিস মার্ডেন, অ্যালেক্সিক ভ্যারোকাস, প্যানাজিওটিস টেটসিস, নিকোস হাডজিকিরিয়োকোস-গিকাস, জন ক্র্যাক্সটন এবং লেখক হেনরি মিলার তাদের মধ্যে অন্যতম।
কানাডার সঙ্গীতশিল্পী ও গীতিকার লিওনার্ড কোহেন ১৯৬০ এর দশকে কয়েক বছর দ্বীপটিতে থেকেছিলেন। দ্বীপে থাকাকালীন তার সময়গুলো অমর হয়ে যায় ‘বার্ড অন দ্যা ওয়্যার’ গানের মাধ্যমে। গানটির একটি অংশ তিনি ইদ্রাতেই লিখেছিলেন।