সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দক্ষ ও অদক্ষ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে আকর্ষণীয় দেশে পরিণত হয়েছে রোমানিয়া৷ বিদেশি কর্মীদের জন্য কয়েক হাজার ভিসা চালু করেছে দেশটির সরকার৷ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশটিতে আসছেন বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিকেরা৷
রোমানিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দাউদ আলী ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান, দেশটিতে গত দুই বছরে ভিসা পয়েছেন ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি৷ রাষ্ট্রদূতের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণ, সেবা, জাহাজ-নির্মাণ শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে তারা ৪০০ থেকে এক হাজার ইউরো বেতনে চাকরি পেয়েছেন৷ এর সঙ্গে অনেক চাকরিদাতা থাকার ব্যবস্থা, খাবার ভাতা এবং আলাদাভাবে বাড়তি সময়ের মজুরিও দিচ্ছেন, যার কারণে অভিবাসীরা তাদের আয়ের বেশিরভাগই বাংলাদেশে পাঠানোর সুযোগ পান বলে উল্লেখ করেন তিনি৷
তারপরও রোমানিয়া ছাড়ছেন তারা
এই সুবিধাগুলোর পর অনেক বাংলাদেশিই রোমানিয়ায় আসার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন৷ তাদের বড় অংশের লক্ষ্য ইটালি৷ রোমানিয়ায় নির্দিষ্ট কোম্পানির কাজের চুক্তিপত্র নিয়ে বৈধভাবে আসার পরও শেষ পর্যন্ত তারা অবৈধ উপায়ে দেশটিতে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন৷ ১৬ আগস্ট রোমানিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইনফোমাইগ্রেন্টকে জানিয়েছে, বর্তমানে সেখানে ১,৬৭৬ জন বাংলাদেশি বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি নিয়ে আছেন৷ তাদের মধ্যে ১৫০৬ জনের চাকরি রয়েছে৷
কিন্তু দেশটিতে ভিসা নিয়ে আসা মোট অভিবাসীদের তুলনায় এই সংখ্যা অনেক কম৷
রোমানিয়া ইউরোপীয় ইউনয়নের সদস্য হলেও শেঙ্গেনভুক্ত নয়৷ বিশেষ ভিসায় আসা বাংলাদেশি কর্মীদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশে যাওয়ার অনুমতি নেই৷ কিন্তু নিজেদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে তারা ট্রাকে করে ইটালিতে যাওয়ার জন্য মানবপাচারকারীদের দ্বারস্থ হন৷ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে এক অভিবাসী জানান, মানবপাচারকারীরা এই যাত্রার জন্য জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার ইউরো করে নেন৷
পরিণামে গ্রেপ্তার
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অবৈধ উপায়ে রোমানিয়া সীমান্ত পার হতে গিয়ে কয়েক ডজন বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ তাদের কয়েকজনকে অভিবাসন বিধি ভঙ্গের অভিযোগে দেশেও ফেরত পাঠানো হয়েছে৷
এই পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দাউদ আলী৷ রোমানিয়া থেকে এভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করায় বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি৷ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘‘অনেক বাংলাদেশি রোমানিয়ায় আসছেন এই লক্ষ্য নিয়ে যে, যখনই সুযোগ পাবেন তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশে চলে যাবেন৷ এই ইইউ দেশটিতে বৈধভাবে আসা সহজ৷ এরপর সহজেই সড়ক পথে কেউ অন্য দেশে চলে যেতে পারেন৷’’
কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় গলদ
রোমানিয়া গত বছর ৪০ হাজার বিদেশি কর্মীকে ভিসা দেয়ার ঘোষণা দেয়৷ এরপর চলতি বছর এই সংখ্যা এক লাখে উন্নীত করা হয়৷ বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম থেকে কর্মী আনার চিন্তা করেই এই উদ্যোগ নেয় দেশটির সরকার৷
কিন্তু দাউদ আলী মনে করেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা নিয়োগ প্রক্রিয়া৷ শুধু রোমানিয়ায় কাজ করতে আগ্রহীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে সরকারের আরো ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি৷ তার মতে, ‘‘বাংলাদেশ যত বেশি সম্ভব কর্মী পাঠাতে চেয়েছে৷ কিন্তু ঢাকা থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময় কোনো চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ছিল না৷ রিক্রুটমেন্ট সংস্থাগুলো এই ক্ষেত্রে কারা রোমানিয়ায় কাজ করতে ইচ্ছুক, কারা নন সেটি যাচাই করেনি৷ তারা শুধু যারা টাকা বেশি দিতে রাজি ছিল তাদেরকে পাঠিয়েছে৷’’
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর উপর নজরদারি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন তিনি৷
অভিবাসীরা যা বলছেন
একটি কারখানায় কাজ নিয়ে কয়েক মাস আগে রোমানিয়া আসেন রিফাত হোসেন ইরান৷ তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে যেমনটা শুনে তিনি এসেছেন তার সঙ্গে বাস্তবতার বিরাট ফারাক রয়েছে৷ কাজ অনুযায়ী বেতন না পাওয়া, সময়মতো বেতন না দেয়া সেই সঙ্গে রিক্রুটিং এজেন্সিকে নিয়মিত কমিশন দিতে হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি৷ বলেন, ‘‘ইউরোপে কাজ করলেও আমাদের সঙ্গে এমনভাবে ব্যবহার করা হয় যেন আমরা মধ্যপ্রাচ্যে আছি৷’’
এই অভিবাসী জানান, আসার আগে তাকে মাসিক ৬০০ ইউরো বেতন ও ওভারটাইমের কথা বলা হয়েছিল৷ কিন্তু একটি ওয়্যারহাউসে কাজ করে তিনি এখন মাসে মাত্র ৪০০ ইউরো আয় করেন, যা তার জন্য যথেষ্ট নয়৷
বাংলাদেশি এই অভিবাসী জানান, কাজের অনুমতিপত্র পেতে রিক্রুটিং এজেন্সিকে সাড়ে সাত লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি, যার পুরোটাই ঋণ করেছেন৷ এই টাকার তার তিন বছরের মধ্যে শোধ করার কথা ছিল৷ হতাশ ইরান বলেন, ‘‘রোমানিয়া এক মরীচিকা, এখানে আশার পর আমি সেটা বুঝতে পেরেছি৷’’ তিনি জানান, তার অনেক বন্ধু এরইমধ্যে ইটালি চলে গেছেন৷ ভবিষ্যতের তিনিও একই উপায় বেছে নেয়ার পরিকল্পনা করছেন৷
তবে বুখারেস্টে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রোমানিয়াকে মোটেও মরীচিকা মনে করেন না৷ কেন বাংলাদেশিরা দেশটি ছেড়ে যেতে চান সেটিও তার বোধগম্য নয়৷ তিনি বলেন, রোমানিয়ায় কাজের অনেক সুযোগ আছে৷ কিন্তু কিছু অভিবাসী সেখানে কাজ করতে চান না৷ তারা চান অবৈধ পথে অন্যত্র চলে যেতে৷’’