কক্সবাজারে এশিয়ার বৃহৎ রেলস্টেশন পুরোপুরি দৃশ্যমান, চালু অক্টোবরে
আপডেট সময়
রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০২৩
স্বপ্ন এখন বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে, আগামী অক্টোবরেই চালু হচ্ছে দেশের প্রথম বিশ্বমানের আইকনিক রেলস্টেশন। অনন্য স্থাপত্যশৈলীর রেলস্টেশনটি দৃশ্যমান। এখন চলছে ঝিনুকের আদলে মুক্তার দানার মধ্যে স্বচ্ছ জলরাশির ফোয়ারা নির্মাণের কাজ। একই সঙ্গে চলছে সৌন্দর্যবর্ধনসহ অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার কাজ, যা সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে অক্টোবরে অপারেশনের উপযোগী হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
ঝিনুক, ঝিনুক, নামটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে যেন সমুদ্রপাড়। সেই ঝিনুকের আদলে সমুদ্র থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়ায় নির্মিত হচ্ছে দেশের একমাত্র বিশ্বমানের পর্যটকবান্ধব আইকনিক রেলস্টেশন। এটিকে বলা হচ্ছে ‘এশিয়ার বৃহৎ রেলস্টেশন’। পর্যটননগরী কক্সবাজারে যা এখন পুরোপুরি দৃশ্যমান।
এটি শুধু একটি স্টেশন নয়, পরিপূর্ণ একটি কমপ্লেক্স। রয়েছে তারকামানের হোটেল, লকার, শপিংমল, রেস্তোরাঁসহ বিশ্বমানের সব সুযোগ-সুবিধা। স্টেশনের অবকাঠামো নির্মাণ এখন প্রায় শেষ। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন।
আইকনিক রেলস্টেশনের সামনে নির্মিত হচ্ছে বিশাল আকৃতির ঝিনুক। ঝিনুকের পেটে মুক্তার দানা। তার চারপাশে পড়ছে স্বচ্ছ জলরাশি। আর মূল আকর্ষণ ঝিনুকের ফোয়ারার কাজ এখন দৃশ্যমান হচ্ছে, যা শেষ হবে এই মাসের মধ্যে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট জানিয়েছেন, আইকনিক রেলস্টেশনের চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো সবই শেষ হয়েছে। এখন চলছে গাড়ি পার্কিং, বাগান, সৌন্দর্যবর্ধন, লাইটিংসহ শেষ পর্যায়ের কাজ। আর কাজের মানেও কোনো ধরনের ত্রুটি নেই বলে দাবি তাদের।
ঝিনুক আকৃতির ফোয়ারা তৈরির দায়িত্বে নিয়োজিত ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ লাভলু হোসেন বলেন, আইকনিক স্টেশন ভবনের আকর্ষণীয় সৌন্দর্যবর্ধনের কাজটি হচ্ছে ঝিনুকের আদলে ফোয়ার তৈরির কাজ। এরই মধ্যে ফোয়ারের সমস্ত পানির সংযোগসহ চারপাশের নির্মাণকাজ হয়েছে। এখন ঝিনুক ও মুক্তার দানা তৈরির কাজ চলছে, যা এই মাসের মধ্যে চেষ্টা করব শেষ করার জন্য। একই সঙ্গে ফুটপাত, পার্কিংসহ নানা কাজও চলমান রয়েছে, যা চেষ্টা করছি দ্রুত শেষ করার।
আরবান সলিউশন্সের পরিচালক সজল বরাল বলেন, আইকনিক ভবনের ভেতরে এবং বাইরের প্রতিটি কলামের যেসব কাজ রয়েছে তা আমাদের প্রতিষ্ঠান করেছে। ভালো মানের পণ্য দিয়ে এবং কাজের মান খুবই মানসম্মতভাবে করা হয়েছে। এই কাজে সর্বোচ্চটা দিয়েছি আমরা। কোনো ধরনের ত্রুটি রাখিনি। কারণ একটি আইকনিক রেলস্টেশন, বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের ভবন এটিই প্রথম। এটি বাংলাদেশের সক্ষমতার নতুন একটি পালক।
আইকনিক রেলস্টেশন ভবন প্রকল্পের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার তাইজুল ইসলাম বলেন, ‘আইকনিক রেলস্টেশন ভবনের এখন শেষ পর্যায়ের কাজগুলো চলছে। বিশেষ করে, সৌন্দর্যবর্ধন যেমন রং-তুলির কাজ, গাড়ি পার্কিং, ঝিনুকের ফোয়ারা, বাগানসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো। চ্যালেঞ্জিং কাজ স্টিল ক্যানোফিসহ অন্যসব কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছি আমরা।’
প্রকল্প কর্মকর্তা বলছেন, সেপ্টেম্বরই কার্য-উপযোগী করে তোলা হচ্ছে বিশ্বমানের আইকনিক রেলস্টেশনটি। আইকনিক রেলস্টেশন ভবনের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার মো. আব্দুল জাবের মিলন বলেন, আইকনিক এ স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক লোক কাজ করছেন। চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি আজ দৃশ্যমান।
মো. আব্দুল জাবের মিলন আরও বলেন, এ স্টেশন হবে এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলাবিশিষ্ট স্টেশন। এতে রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। পর্যটকরা যেন কক্সবাজারে দিনে এসে ঘুরে আবার ফিরে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। স্টেশনে রাখা হচ্ছে লাগেজ ও লকার সিস্টেম। এ ছাড়া থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা। স্টেশনের নিচতলায় থাকছে টিকেট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, লকারসহ নানা সুবিধা। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ। তিন তলায় থাকবে তারকা মানের হোটেল। থাকছে মসজিদ, শিশু যত্ন কেন্দ্র ও চলন্ত সিঁড়ি। এখনে থাকছে এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, টুরিস্ট ইনফরমেশন বুথসহ নানা সেবাকেন্দ্র।
কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার মো. আব্দুল জাবের মিলন বলেন, এখন যে কেউ এলে আইকনিক স্টেশনের কাজ যে শেষের পথে তা বুঝতে পারবে। এ স্টেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্টিল ক্যানোফি বসানোর যে কাজটি ছিল, তা-ও শেষ হয়েছে। ‘ফিনিশিং, টাইলস, গ্লাস লাগানো, চলন্ত সিঁড়িসহ সব কাজই আমাদের টার্গেট অনুযায়ী এগিয়ে নিয়েছি। আশা করি, সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে অক্টোবরে অপারেশনের কার্য-উপযোগী হবে।
২৯ একর জমির ওপর ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে এক লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুটের আইকনিক স্টেশনটি। আর স্টেশনের পশ্চিম পাশে একসঙ্গে নির্মিত হয়েছে ৫ তলা ২০টি ভবন।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে মেগা প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ মেগা প্রকল্পে ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
প্রকল্পে যা আছে: দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে। রেলপথে স্টেশনের সংখ্যা থাকছে ৯টি। এগুলো হলো: সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়ার সাহারবিল, ডুলাহাজারা, ঈদগাও, রামু, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও ঘুমধুম। এতে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম থাকবে ৯টি, ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম থাকবে ৯টি। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে সেতু। এ ছাড়া ৪৩টি মাইনর সেতু, ২০১টি কালভার্ট, সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় একটি ফ্লাইওভার, ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং এবং রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং রয়েছে।