বাংলাদেশি নাগরিকদের সব ধরনের ভিসা দেয়া স্থগিত করেছে ওমান। দেশটির রয়্যাল পুলিশ এক ঘোষণায় এটি জানিয়েছে। একই সাথে ‘টুরিস্ট’ কিংবা ‘ভিজিট ভিসা’ নিয়ে ওমান গেলে সেটি ‘ওয়ার্ক ভিসায়’ পরিবর্তন করা যাবেনা। গত ৩১শে অক্টোবর থেকে সব দেশের জন্য এটি কার্যকর করা হয়েছে।
ওমানের জনসংখ্যা ৫০ লাখের মতো। বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে বলা হচ্ছে, ওমানে ২০ লাখের মতো প্রবাসী শ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সংখ্যা সাত লাখের উপরে।
ঢাকায় ওমান দূতাবাসের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হচ্ছে “এটি ওমানি শ্রম বাজারের চাহিদা ও স্থিতিশীলতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার একটি প্রয়াস” যার উদ্দেশ্য বর্তমান শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিক ও নিয়োগকর্তা উভয়ের অধিকার নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে দূতাবাস বিষয়টিকে ‘সাময়িক পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। এছাড়া বিষয়টি কোনভাবেই ‘রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
ওমানে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে বলা হচ্ছে, সেখানে যত বাংলাদেশি আছেন সে তুলনায় কর্মসংস্থান নেই। ফলে অনেকেই যারা আগে থেকে চাকরি নিশ্চিত করে যাচ্ছেন না। তাদের অনেককে বেকার থাকতে হচ্ছে অথবা স্বল্প মজুরিতে তাদেরকে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, যেটা তাদের শ্রম অধিকার খর্ব করে।
ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাসের উপ-প্রধান মৌসুমী রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, অনেক সময় কাজ না পেয়ে তারা দালালদের খপ্পরে পড়ে পাচারেরও শিকার হন। অনেকে ইরান বা তুরস্কের মতো দেশ হয়ে ইউরোপ পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেন। এমন নানাবিধ কারণে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং অধিকার নিশ্চিত করতেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
“পুরো জিনিসটা রিস্ট্রাকচার করে ওদের যদি কোনো পলিসিগত পরিবর্তন করতে হয় সেটা করে তারা আবার এটা চালু করবে” বলছিলেন মৌসুমী রহমান।
বাংলাদেশিরা সাধারণত ‘টুরিস্ট ভিসায়’ না গেলেও ‘ভিজিট ভিসায়’ অনেকে ওমান যান, যাদের অনেকেই আর কাজ পান না।
মৌসুমী রহমান বলেন, দূতাবাসে প্রতিনিয়তই ৫০-১০০ জন করে আসেন, যারা জানান যে মাস বা বছরব্যাপী থেকেও ওমানে কোনো কাজ পাননি তারা এবং দেশে ফিরে যেতে চান।
বিদেশে কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা যেসব দেশে গন্তব্য হিসেবে বেছে নেন তার মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে আছে ওমান।
২০২২ সালে অবশ্য একধাপ এগিয়েছে ওমান। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসেবে ২০২২ সালে সৌদি আরবের পর দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ওমান। সে বছর ওমানে গিয়েছিল প্রায় এক লাখ আশি হাজার বাংলাদেশি।
অভিবাসন নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরু বলছে, চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক লাখের বেশি বাংলাদেশি এরই মধ্যে ওমানে পাড়ি দিয়েছে।
“এটা বাংলাদেশের একটা ট্রেন্ড (প্রবণতা) যে একটা দেশে লোক পাঠাতে থাকলে অনবরত সেটা চলতেই থাকে,” বলছিলেন রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, কোন একটি দেশে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি চলে গেলে তখন এমন ‘নিষেধাজ্ঞা’ দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
“সংযুক্ত আরব আমিরাতে দেখা গেছে এমন নিষেধাজ্ঞা, সৌদি আরবেও ছয় সাত বছর ছিল এমন নিষেধাজ্ঞা, এটাও সেরকমই একটা নিষেধাজ্ঞা,” বলেন অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী।
নানা কারণে মালয়েশিয়াতেও চার বছরের মতো বাংলাদেশি কর্মী নেয়া বন্ধ ছিল, যেটা ২০২২ সালের অগাস্ট মাস থেকে আবার শুরু হয়েছে। বাহরাইনেও বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ ছিল প্রায় সাড়ে চার বছর। পরবর্তীতে এটি আবারো চালু হয়েছে।
ওমানে ভিসা বন্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ঠিকমতো চাকরির বন্দোবস্ত না করেই অনেককে আদম ব্যবসায়ীরা পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে হয়তো সাময়িক এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। কেউ যাতে অবৈধ অভিবাসনে না যান সেই অনুরোধও করেন তিনি।
ওমানে এমন সিদ্ধান্তের প্রাথমিক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের উপর। রিজার্ভ সংকটের মধ্যে বিদেশে একটি বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া বড় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
“আমাদের যদি ৫০ হাজার লোকও বছরে কোনো দেশে গিয়ে থাকে সেটা বন্ধ হলে তো সেটার রেমিট্যান্সের সুযোগও বন্ধ হয়ে যাবে” বলছিলেন আন্তর্জাতিক রিক্রুটিং এজেন্সিদের সংস্থা বায়রার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবুল বাশার।
ঢালাওভাবে বেশি কর্মী কোনো দেশে গেলে তাদেরকে নিয়ে যখন সমস্যা দেখা দেয় তার প্রভাবটা পড়ে অন্যদের উপরে এসে পড়ে।
মিঃ বাশার বলছিলেন, “আমাদের আবুধাবি বন্ধ হয়ে গেলো, এখন ওমান, পাশাপাশি যদি কুয়েত বা কাতার বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমাদের লোক যাওয়ার মতো জায়গা সৃষ্টি হচ্ছে না।”
এই শঙ্কা যে শুধু মিঃ বাশারের তেমনও না। যে কারণে ওমানে ভিসা দেয়া বন্ধের কথা উঠে আসছে সেই একই কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতেও ভিসা দেয়া বন্ধ হতে পারে বলে মনে করেন দুবাইতে গালফ নিউজের সাবেক সিনিয়র সাংবাদিক সাইফুর রহমান।
“কোভিড-১৯ মহামারির পর প্রচুর বাংলাদেশি আরব আমিরাতে গিয়েছেন যাদের কিছু অংশের মাত্র কাজের সুযোগ হয়েছে, বাকিরা অবৈধ অভিবাসী হয়ে গেছে,” বলেন মি. রহমান।
“অবৈধের সংখ্যা যখন মাত্রাধিক হয়ে যায় তখন একটা নিরাপত্তা হুমকির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন সেই দেশের নাগরিককে হাই রিস্ক ক্যাটাগরিতে ফেলে ভিসা স্থগিত করে দেয়, অনেক সময় ট্যুরিস্ট ভিসাও বন্ধ করে দেয়,” বলছিলেন মিঃ রহমান।
তিনি বলেন, দুটি বড় এয়ারলাইন- এমিরেটস এবং ফ্লাই দুবাই – ব্যবসায়িক স্বার্থে এখন পর্যন্ত দুবাই ভিসা দিচ্ছে, কিন্তু সরকার হস্তক্ষেপ করে সিদ্ধান্ত নিলে সেখানেও বাংলাদেশিদের ভিসা স্থগিতের সম্ভাবনা রয়েছে।
আরব দেশগুলোতে কর্মী যাতায়াতের ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকার মতো শক্তভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় না বলেই ঢালাওভাবে অদক্ষ কর্মী যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে মনে করেন তিনি।
এই মুহূর্তে ওমানের ভিসা বন্ধ হয়ে যাবার বিষয়টি বাংলাদেশের বাজারের উপর খুব বড় প্রভাব পড়বে মনে করছেন না তাসনীম সিদ্দিকী।
“এই বছর হয়তো একটু কম যাবে, পরের বছর দেখা যাবে আরেকটা দেশ বের করে সেখানে যাচ্ছে” বলছিলেন তিনি।
এর আগেও যতবার হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের জন্য খুব বিশাল কোনো সংকট হিসেবে আসেনি বলেই উল্লেখ করেন মিস সিদ্দিকী।
তবে দীর্ঘমেয়াদে এমন সমস্যা ঠেকাতে কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে জোর দেন অধ্যাপক সিদ্দিকী। এর পাশাপাশি বৈধ কাগজপত্র এবং চাকরি নিশ্চিত করে প্রবাসে যাওয়া জরুরী বলে মনে করেন তিনি।
নানা অনিয়মের কারণে যখন কোনো একটি দেশে এমন ভিসা স্থগিত করা হয় তখন সে কারণে বৈধভাবে যাতায়াতকারীদের উপরে প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন অধ্যাপক সিদ্দিকী।
বিবিসি বাংলা