বাংলাদেশে বিটকয়েনসহ ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন নিষিদ্ধ হলেও মাল্টিলেভেল মাকেটিং (এমএলএম) পদ্ধতিতে ব্যবসা করছিল ‘এমটিএফই’ নামে দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটিতে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন চলত। বাংলাদেশের প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করে কমপক্ষে এক লাখ টাকা করে। আর কোম্পানির আড়ালে তাদের টাকা বিদেশে পাচার করেছে বাংলাদেশি একটি চক্র। যাদের শনাক্ত করতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি ইউনিট। কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট।
আর এসব বিনিয়োগ লোপাট করে হঠাৎ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় কোম্পানিটি। শনিবার কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে- বিনিয়োগ ও অর্থ উত্তোলনসহ কোনো প্রক্রিয়া কাজ করছে না। আর বিনিয়োগকারীরাও নিশ্চিত হয়েছেন যে, তাদের অর্থ আত্মসাত করে উধাও হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ধারণা করা হচ্ছে- বিটকয়েনে লেনদেনের নামে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ থেকে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তবে, দেশে বিটকয়েনসহ ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধ হলেও অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছিল প্রতিষ্ঠানটি। দেড় শতাধিক অফিস ছিল খোদ রাজধানীতেই। পেছনে ছিলেন রাঘববোয়ালরা- যারা এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। তারা আড়ালে থেকেই শুরু থেকেই এই ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ছক কষছিলেন- যা বুঝতেই পারেননি বলে আলাপকালে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন বিনিয়োগকারী জানান।
জানা গেছে, কোম্পানিটি এমএলএম ব্যবসার ছদ্মবেশে অনলাইন গ্যাম্বলিং ও ক্রিপ্টো ট্রেডিং করত। ফোরেক্সও হত এখানে। এটির ওয়েবসাইট ছিল। আর অ্যাপের মাধ্যমে চলতো। লেনদেনও হতো ওয়েবসাইট বা অ্যাপেই। এই ব্যবসায় জড়িত প্রতারকচক্র বিভিন্ন নামিদামি হোটেলে মিটিং করে বিনিয়োগকারী ধরার ফাঁদ পাততো। স্বল্প বিনিয়োগে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখাতো তারা। আর এই ফাঁদে পরেই এখন অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ নিস্ব।
ভারত ও বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিনিয়োগকারী ছিল। তবে অধিকাংশই বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী বলে অভিমত সাইবার বিশ্লেষকদের।
তবে চক্রের আড়ালে ছিলেন কারা? কারা এই ব্যবসা বাংলাদেশে সম্প্রসারণ করছিলেন- সেই হোতারা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
ক্ষতিগ্রস্ত একজন বিনিয়োগকারী বলেন, কোম্পানিটির বাংলাদেশে সিইও পদমর্যাদার ব্যক্তি রয়েছেন ৪০০ জনের অধিক। শুধু রাজধানীতেই এই সিইওদের আড়াইশ অফিস উদ্বোধন হয়েছে। আর সিইও হওয়ার তালিকায় রয়েছেন আরও এক হাজার ব্যক্তি। একেকজন সিইওর অধীনে রয়েছেন অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ জন সাধারণ বিনিয়োগকারী।
প্রায় দুই বছর ধরে এই কোম্পানির সঙ্গে থাকা এক বিনিয়োগকারী জানান, দুবাইভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পঞ্জি মডেলে ব্যবসা করতো।
তিনি নিজেও একজন সিইও জানিয়ে ওই ব্যক্তি বলেন, ৯৩০ ডলার বা ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে মাসে ৪৫ হাজার টাকা লাভ দিত কোম্পানিটি। ৫০০ ডলার বা ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে ২২ হাজার টাকা লাভ দিতো। এছাড়া কেউ যদি ৩ হাজার ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করে এবং ১৫ জন ব্যক্তিকে কোম্পানিতে যুক্ত করে আর এই ১৫ জন মিলে যদি ৯ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে তাহলে ৩ হাজার ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করা ব্যক্তি প্রতি মাসে অন্তত ৪ লাখ টাকা করে লাভ পেয়ে থাকে। এভাবেই শত শত যুবককে কোটিপতি বানিয়েছে এই কোম্পানি।
তবে হঠাৎ করে কোম্পানিটি উধাও হয়ে যাবে তিনি তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। গত ১৫ দিন ধরে টেকনিক্যাল সমস্যার কথা জানিয়ে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কমিশন প্রদান বন্ধ রাখে। এখানে যারা টাকা রেখেছেন- তারা টাকা উত্তোলন করতে পারছিলেন না। গত একপর্যায়ে বৃহস্পতিবার থেকে কোনও লেনদেনই করা যাচ্ছিল না। আর গত শুক্রবার পুরোপুরিভাবে এমটিএফই তাদের অর্থ লেনদেনের সিস্টেমই বন্ধ করে দিয়েছে।
বিনিয়োগকারীরা জানান, কমপক্ষে ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে দিন শেষে পাঁচ হাজার টাকা লাভ আসবে। এই কল্পিত মুনাফার লোভে শত শত মানুষ বিনিয়োগ করেছিলেন। অনেকে গয়না এবং মূল্যবান সামগ্রী বন্ধক রেখেও বিনিয়োগ করেছিলেন।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেসবুকের নিউজ ফিডে বিভিন্ন বিদেশি অ্যাপের লোভনীয় মুনাফার বিজ্ঞাপন প্রচারের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অনলাইন প্রচার চালায় কিছু যুবক। এই অ্যাপসের একাধিক হেল্প অফিসও খোলা হয়েছে রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে।
জানা গেছে, অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তারা টাকা নিতো। পরে স্থানীয় এজেন্টরা সেটি বাইরে পাচার করতো। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য এই কম্পানির লেনদেন বা ট্রেড হতো সপ্তাহে ৫ দিন বাংলাদেশি সময় রাত ৭ থেকে রাত ১টা পর্যন্ত। সোমবার থেকে শুক্রবার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ট্রেড হলেও সিইওদের জন্য লেনদেন হতো শনিবারসহ সপ্তাহে ৬ দিন। রবিবার বন্ধ থাকতো।
এ বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো বিনিয়োগকারী এখনও আইনের আশ্রয় নেননি বা থানায় কোনো অভিযোগ করেননি বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের কেউ (বিএফআইইউ) বলছে, ক্রিপ্টোকারেন্সি বাংলাদেশে অবৈধ। এই অর্থ পাচারে যারা জড়িত তাদের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হবে।
অন্যদিকে, ইতোমধ্যেই বিষয়টি জানতে পেরেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা তদন্তে নেমেছে বলে সিআইডির একটি সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র : ঢাকা টাইমস