অনিয়মিত পথে গত বছর অন্তত আট হাজার ৬৬৭ জন বাংলাদেশি ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ঢুকেছেন। ইউরোপের বহিঃসীমান্তরক্ষী সংস্থা ফ্রনটেক্স-এর হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে অবৈধভাবে ইতালি প্রবেশের তালিকায় বাংলাদেশিরা রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে।
গন্তব্য ইউরোপ
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলো উর্ধ্বমুখী। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রতি বছর। এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ উন্নত জীবনের স্বপ্নে ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ পাড়ি জমাচ্ছেন।
ইউরোপের বহিঃসীমান্তরক্ষী বাহিনী ফ্রনটেক্সের হিসেবে গত বছর আট হাজার ৬৬৭ জন অবৈধ উপায়ে ইইউ দেশগুলোতে প্রবেশ করেছেন। এর মধ্যে সাত হাজার ৫৭৪ জনই এসেছে মধ্য ভূমধ্যসাগর হয়ে। ৬০৪ জন প্রবেশ করেন পূর্ব ভূমধ্যসাগর দিয়ে, আর ৪৩৭ জন ঢুকেছেন পশ্চিম বলকান দিয়ে।
ফ্রনটেক্সের এই তালিকায় লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালিতে আসাদের মধ্যে বাংলাদেশিদের অবস্থান দ্বিতীয়। এই পথ পাড়ি দিয়ে ইতালির লাম্পেদুসায় পৌঁছাতে গিয়েই গত মাসে সাত বাংলাদেশি ঠান্ডায় মারা যান।
রোমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান জানান, দেড় লাখের মতো বাংলাদেশি অভিবাসী বর্তমানে ইতালিতে বসবাস করছেন। এত বাংলাদেশি নেই ইইউভুক্ত আর কোনো দেশে।
তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, এমন একটা ধারণা মানুষের মধ্যে আছে যে ইতালি বিদেশিদের প্রতি খুবই আন্তরিক। তারা মনে করে কোনোভাবে দেশটিতে আসতে পারলে এক পর্যায়ে বৈধতা পাওয়া যাবে।
বৈধ অভিবাসনের সীমিত সুযোগ
আট বছর বন্ধ থাকার পর ইতালি বাংলাদেশিদের জন্য সিজনাল ও নন সিজনাল ভিসা আবেদনের সুযোগ করে দিয়েছে। এই স্কিমের অধীনে বাংলাদেশসহ ৩০টি দেশ থেকে ৬৯,৭০০ অভিবাসীকর্মী আনার অনুমতি দিয়েছে দেশটির শ্রম ও সামাজিক পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান বলেন, বাংলাদেশের অভিবাসীদের ইতালিতে বৈধপথে আসার চেষ্টা করা উচিত। কেননা অবৈধদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সাক্ষরিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসেডিউর্স (এসওপি) এর আওতায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইতালিতে বাংলাদেশিদের জন্য বৈধপথে আসার সুযোগ এখনও বেশি সীমিত। ইতালির ভেনিসে অবস্থানরত বাংলাদেশি সাংবাদিক পলাশ রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সার্কুলারের অধীনে মাত্র সাড়ে তিন হাজার বাংলাদেশি আসার সুযোগ পাবে। ইউরোপে আসতে আগ্রহীদের তুলনায় এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।
তিনি মনে করেন, অনিয়মিতি উপায়ে ইউরোপে আসার প্রবণতা বন্ধ করতে হলে বৈধ উপায়ে আসার সুযোগ আরো বৃদ্ধি করতে হবে।
গত বছর লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালি আসেন বাংলাদেশের সবুজ। ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমি লিবিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। পরিবারের আট জনের মধ্যে আমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
২০২০ সালে প্রায় চার লাখ টাকা খরচে লিবিয়া পৌঁছান ২৫ বছর বয়সী এই যুবক। সেই সময় অবশ্য তার ইতালি যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। লিবিয়ার বেনগাজিতে শুরুতে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তিনি। কিন্তু সেখানে নিয়মিত বেতন পেতেন না। বকেয়া চাইতে গেলে উল্টো মারধরের শিকার হতেন বলে জানান তিনি। এক পর্যায়ে সবুজ উন্নত জীবনের আশায় লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
‘একটি নৌকায় করে ২৪ ঘণ্টা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আমরা ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি লাম্পেদুসা দ্বীপের কাছে পৌঁছাই। ওই নৌকায় মোট ৯৩ জন ছিলেন। এর মধ্যে ৪০ জনের বেশি ছিলেন আমাদের দেশি।’
ইতালি পৌঁছানোর পর থেকে রোমে একটি অভিবাসন কেন্দ্রে রয়েছেন সবুজ। তার স্বপ্ন ইউরোপীয় দেশটিতে একটি ভালো চাকরি করা, যদিও সেই স্বপ্ন এখনও অধরা।
সবুজ বলেন, আমাকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি আসতে দুই হাজার ইউরো খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু এখনও আমি বেকার। এখানে কাউকে চিনি না আমি। কেউ এখানে আমাকে চাকরি দিচ্ছে না। দেশে এখনও আমার মা মানুষের ঘরে কাজ করছে। জানি না সামনে কী আছে।
ট্রানজিট লিবিয়া
সমুদ্রপথে ইতালিতে আসা অভিবাসীদের বড় একটি অংশই পাড়ি জমান উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া থেকে। ইউএনএইচসিআর এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি মাসে সমুদ্রপথে ইতালিতে পৌঁছেছেন দুই হাজার ৯৯৫ জন। এর মধ্যে ২০৯১ জনই লিবিয়া থেকে এসেছেন। এদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশি।
লিবিয়ায় অবস্থানরত অভিবাসীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা আইওএম এর সবশেষ প্রকাশিত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে ২০ হাজার ২৫৪ জন বাংলাদেশি ছিলেন, যা মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে আগত অভিবাসীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ।
ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অভিবাসীদের ২৪ শতাংশ দেশটিতে এসেছেন তুরস্ক হয়ে। ১৯ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর হয়ে এবং ১৬ শতাংশ এসেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তুরস্ক হয়ে। বাকি ৪১ শতাংশ অন্য রুট যেমন, ভারত, কাতার, কুয়েত, জর্ডান, টিউনিশিয়া বা অন্যকোনো দেশ ঘুরে লিবিয়া আসেন।
এজন্য তারা বাংলাদেশি মুদ্রায় জনপ্রতি প্রায় আড়াই লাখ টাকা থেকে (২,৬৮২ ডলার) থেকে সোয়া তিন লাখ টাকার বেশি (৩৮৬৩ ডলার) ব্যয় করেন। পরে সেখান থেকে তারা ইউরোপে বিশেষ করে ইতালিতে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
সূত্র: ইনফো মাইগ্রেন্টস