তালেবানের নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ হয়ে গেল আফগানিস্তানের সব বিউটি পারলার। এর ফলে হাজার হাজার নারী জীবিকা হারাচ্ছেন। বাইরে যাওয়া নিয়ে বিধিনিষেধের বেড়াজালের মধ্যে একটু স্বস্তির জায়গা ছিল এসব বিউটি পারলার। রূপচর্চার সুযোগে এসব জায়গায় ছিল আফগান নারীদের দুঃখ-কষ্ট ভোলার জায়গা। পারলার বন্ধের ফলে তাদের মধ্যে যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এই পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল জারমিনার। স্বামী ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না তাঁর। তা-ও বছরে দুই-তিনবার প্রতিবেশীর সঙ্গে বিউটি সেলুনে যেতে রাজি করিয়েছিলেন তিনি। সেখানকার এক কর্মীর সঙ্গে বেশ সখ্যও গড়ে ওঠে তাঁর। বিউটিশিয়ানের সঙ্গে সামান্য আলাপেই যা একটু মুক্তির স্বাদ পেতেন তিনি।
কাবুলের এক পারলারে নিজের চুলে রং করাতে করাতে জারমিনা বিবিসিকে বলেন, ‘আগে মেয়েরা তাদের স্বামীকে প্রভাবিত করার নানা উপায় নিয়ে আলোচনা করত। কেউ কেউ তাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। কিন্তু এখন তারা কেবল বেকারত্ব, বৈষম্য আর আর্থিক দুর্দশা নিয়েই কথা বলে।’
২০২১ সালের আগস্টে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবানরা আবার ক্ষমতায় আসে। এরপর নারীদের স্বাধীনতা ক্রমাগত কমছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শরীরচর্চা ও বিনোদনকেন্দ্র নিষিদ্ধের পর আফগান নারীদের যাওয়ার মতো এই একটি জায়গা ছিল। গত মাসে হঠাৎ পারলার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় তালেবান সরকার।
ঘর থেকে সব সময় মাথায় স্কার্ফ মুড়িয়ে বের হন মদিনা। কেবল তাঁর স্বামী ও পরিবারের নারী সদস্যরা তাঁর রঙিন চুল দেখতে পায়। ২২ বছর বয়সী মদিনা কাবুলে থাকেন। তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে হালের সব বিউটি ট্রেন্ড ফলো করেন। তাঁর মতে, বিউটি সেলুন তাঁর বিয়েকে সতেজ রেখেছে।
মদিনা বলেন, ‘আমার জানা মতে, সব নারী তার স্টাইল উন্নত করতে পছন্দ করে। আমারও হালের ফ্যাশন আর মেকআপ পরা পছন্দ।’
মদিনার স্বামী তাঁর রঙিন চুল, বাহারি কাটের স্টাইল খুব পছন্দ করেন। তিনি প্রায়ই তাঁকে বিউটি সেলুনে নিয়ে যান এবং ধৈর্য ধরে বাইরে তাঁর অপেক্ষা করেন। স্বামীর প্রশংসা পেতে খুব পছন্দ করেন তিনি।
ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বিউটি সেলুনে যেতেন মদিনা। তাঁর স্মৃতিতে ভাসে, তখন নারীরা নিজেদের জীবনের গল্প বলাবলি করতেন। কিন্তু এখন কেউ মন খুলে কথা বলেন না। চারদিকে ভয়। আগে বর তাঁর বউকে তৈরি হতে দেখতে পারতেন। কখনো কখনো ছবিও তুলতেন। এখন সব নিষিদ্ধ।
মাজার-ই-শরিফের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দা সোমায়ার জন্য বিউটি সেলুন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেবা। তিন বছর আগে হিটার বিস্ফোরণে সোমায়ার চেহারা, চোখের ভ্রু, চোখের পাতা পুড়ে যায়।
কষ্ট ও যন্ত্রণার কথা তুলে ধরে সোমায়া বলেন, ‘আমি আমার চেহারার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমাকে কুৎসিত দেখাচ্ছিল। আমার মনে হতো, সবাই আমাকে দেখছে, আমার ভ্রু নেই, তাই আমাকে নিয়ে হাসছে।’
সোমায়া আরও বলের, ‘চিকিৎসা আমার ক্ষত সারালেও, আমার নিজেকে ফিরে পেতে সাহায্য করেছে বিউটি সেলুন।’ বিউটি সেলুনে মাইক্রো ব্লেডিংয়ের মাধ্যমে অর্ধস্থায়ী ভ্রু আঁকাত সোমায়া। তাঁর মতে, বিউটি সেলুন তাঁর জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে।
মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতেন সোমায়া। তাঁর মতে, সেলুন মেকআপ করার জায়গার চেয়ে বেশি কিছু। অনেকের কাছেই বিউটি পারলার থেরাপির মতো। তাঁরা এখানে কেবল সাজতে নয়, দুঃখ-কষ্ট ভুলতেও আসে।
জারমিনা, মদিনা আর সোমায়ার মতো অনেকের কাছে অর্থ আছে, কিন্তু নিজে খরচ করার স্বাধীনতা আর নেই।