২০১২ সাল থেকে গোল্ডেন ভিসার মাধ্যমে বিদেশীদের স্থায়ী অভিবাসনের সুযোগ দিচ্ছে পর্তুগাল সরকার। এ কর্মসূচির আওতায় এতদিন দেশটির রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ বা মূলধন স্থানান্তর অথবা নতুন ব্যবসা চালুর মাধ্যমে পর্তুগালে স্থায়ী অভিবাসনের সুযোগ ছিল। বিশেষ করে রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রচুর বিদেশী নাগরিক সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নিয়েছেন।
এক্ষেত্রে তাদের দুই ধরনের ক্যাটাগরিতে বিনিয়োগ করে দেশটির রেসিডেন্ট পারমিট সংগ্রহ করতে হয়েছে। এর মধ্যে একটি ক্যাটাগরিতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বিনিয়োগ করতে হয়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ ইউরো (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকার বেশি)। আরেকটি ক্যাটাগরিতে (রিয়েল এস্টেট আরবান রিহ্যাবিলিটেশন ক্যাটাগরি) বিনিয়োগ করতে হয়েছে সাড়ে ৩ লাখ ইউরো (৪ কোটি টাকার বেশি)।
ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেশন আউটলুক ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে পর্তুগালে নাগরিকত্ব নিয়েছেন ৩ হাজার ৩৬৩ জন বাংলাদেশী। এর মধ্যে শেষের পাঁচ বছর ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যেই নিয়েছেন ২ হাজার ৫৬৮ জন। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি নাগরিকত্ব গ্রহণকারী অভিবাসীদের উৎস হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অষ্টম। পর্তুগালে বাংলাদেশীরা নাগরিকত্ব সবচেয়ে বেশি নিয়েছে ২০২১ সালে। ওই বছর দেশটির নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ৭৮৮। দেশটিতে অভিবাসন গ্রহণকারী বাংলাদেশীদের একটি অংশ সেখানকার পাসপোর্ট নিয়েছেন ব্যয়বহুল গোল্ডেন ভিসার সুবাদে।
স্থানীয় গণমাধ্যম ও অভিবাসন সেবাদাতা কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমেই পর্তুগালে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিদেশী গোল্ডেন ভিসার সুবিধা নিয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ খাতে বিদেশীদের বিনিয়োগ ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় দেশটির আবাসন খাতে স্থানীয়দের ব্যয়ও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে গোল্ডেন ভিসার সুযোগ বন্ধের ঘোষণা দেয় পর্তুগিজ সরকার, যা চলতি মাসেই কার্যকর হয়েছে।
তবে পর্তুগালে মূলধন স্থানান্তর (ক্যাপিটাল ট্রান্সফার) বা বিজনেস ক্যাটাগরিতে গোল্ডেন ভিসা গ্রহণের সুযোগ এখনো রয়েছে। ক্যাপিটাল ট্রান্সফার ক্যাটাগরিতে গোল্ডেন ভিসার জন্য অভিবাসনপ্রত্যাশীকে নির্দিষ্ট কিছু ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডে কমপক্ষে ৫ লাখ ইউরো বিনিয়োগ করতে হয়। এছাড়া এ ক্যাটাগরিতে কমপক্ষে ১০টি কর্মসংস্থান তৈরি বা সরকারি-বেসরকারি বৈজ্ঞানিক গবেষণা খাতে অন্তত ৫ লাখ ইউরো বিনিয়োগের মাধ্যমেও পর্তুগালের গোল্ডেন ভিসা পাওয়া যাবে। এর বাইরেও শিল্প ও সংস্কৃতি খাতের নির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রমে আড়াই লাখ ইউরো বিনিয়োগের মাধ্যমে গোল্ডেন ভিসায় আবেদনের সুযোগ রয়েছে।
বিজনেস ক্যাটাগরিতে ৫ লাখ ইউরো বা তার বেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে অন্তত পাঁচটি স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী পর্তুগিজ আইনের অধীনে নিবন্ধিত নতুন কোম্পানি গঠনের মাধ্যমেও এ ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। তবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বৈধভাবে মূলধন স্থানান্তরের সুযোগ নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় অর্থ পাচারসহ অবৈধ নানা পন্থায় মূলধন স্থানান্তরের মাধ্যমে এদেশী ধনীরা পর্তুগালে গোল্ডেন ভিসা গ্রহণ করেছেন বলে সন্দেহ অভিবাসনসংশ্লিষ্টদের।
বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে খ্যাতি রয়েছে পর্তুগালের। জীবনমান ও মানব উন্নয়ন সূচকেও দেশটির অবস্থান শীর্ষ সারিতে। পর্তুগালের নাগরিকত্ব বা স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতিপ্রাপ্তদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শেনঝেনভুক্ত অঞ্চলে বাধাহীনভাবে চলাচল ও কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। চিকিৎসা সুবিধার দিক থেকেও বিশ্বের শীর্ষস্থানে থাকা দেশগুলোর অন্যতম পর্তুগাল। মূলত এসব সুযোগ-সুবিধার কারণেই বাংলাদেশী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে গন্তব্য হিসেবে আকর্ষণ বাড়ছে দেশটির। এছাড়া সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেও দেশটিতে অভিবাসনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন অনেকে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যারা পর্তুগালে নাগরিকত্ব নিয়েছেন তারা কীভাবে নিয়েছেন সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। অনেকে অ্যাসাইলাম নিয়ে পর্যায়ক্রমে নাগরিকত্ব নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে জাল নথিপত্রের ঘটনা থাকতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে অ্যাসাইলাম নেয়ার মতো বাস্তবসম্মত কারণও থাকে। অনেকে হয়তো দীর্ঘদিন দেশটিতে আছে, তার ওপর ভিত্তি করে একটা পর্যায়ে নাগরিকত্ব নিয়ে থাকেন। আরেকটি বিষয় হলো তথাকথিত রেড পাসপোর্ট। এ পাসপোর্টধারীরা অবৈধভাবেই দেশটিতে যান। কারণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রেড পাসপোর্ট নিতে হলে যে পরিমাণ অর্থ নিয়ে যেতে হয়, সেটি বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
গোল্ডেন ভিসার বাইরেও শরণার্থী বা শিক্ষার্থী হিসেবে গিয়ে পর্তুগালে স্থায়ীভাবে থেকে যাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশী। নির্দিষ্ট সময় পর আবেদন করে তারা নাগরিকত্বও পেয়ে যাচ্ছেন। তবে গোটা প্রক্রিয়ায় তাদের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। লিসবনে বাংলাদেশী দূতাবাস স্থাপন করা হলেও বাংলাদেশে এখনো সরাসরি পর্তুগিজ কনস্যুলার সেবা গ্রহণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য শুরুতে অনেকেই বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের শেনঝেন ভিসার আওতাভুক্ত অন্য কোনো দেশে যাচ্ছেন। আবার প্রতিবেশী ভারতের ভিসা নিয়ে দিল্লিতে স্থানীয় দালালচক্রের মাধ্যমে গ্লোবাল ভিসা সার্ভিসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তারপর পর্তুগালের ভিসা আবেদন করতে হচ্ছে অনেককে। ভিসা অনুমোদন হলে নিজে গিয়ে বা প্রতিনিধির মাধ্যমে পাসপোর্ট জমা দিতে হয়। এরপর ৪৮ ঘণ্টা সময় নিয়ে ভিসা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হয়। আবার ঢাকায় পর্তুগিজ কনস্যুলার সেবা না থাকায় পর্তুগালের নাগরিকত্ব পাওয়ার পরও স্ত্রী-সন্তানদের দেশটিতে নিয়ে যেতে অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশীদের। এত ভোগান্তির পরও অভিবাসন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশীদের কাছে দিনদিন আকর্ষণ বাড়ছে পর্তুগালের।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) নির্বাহী পরিচালক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইউরোপের অন্যান্য দেশে বৈধ অভিবাসী হওয়ার নিয়মকানুনে বেশ কড়াকড়ি রয়েছে। সে তুলনায় পর্তুগাল তুলনামূলক উদার। অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের মানুষগুলোই ইউরোপে বিভিন্ন পন্থায় নাগরিকত্ব নিচ্ছেন। পর্তুগালও তেমন একটি গন্তব্য বলে মনে করি। এছাড়া একটি অংশ আছে যারা অন্য দেশ হয়ে পর্তুগালে প্রবেশ করছেন।’
গোল্ডেন ভিসা বা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ—যে উপায়েই হোক না কেন অভিবাসনকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অভিবাসন একটি স্বাভাবিক বিষয়। এতদিন পর্যন্ত যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো সনাতনী গন্তব্যগুলোয় বড় ধরনের অভিবাসন দেখা গেছে। সে তুলনায় পর্তুগাল নতুন একটি গন্তব্য। এখানকার সম্ভাবনা বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলেই পর্তুগালে বাংলাদেশের দূতাবাস খোলা হয়েছে। দেশটি কৃষি খামারগুলোয় অনেক বাংলাদেশীর কর্মসংস্থান হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পর্তুগালের সঙ্গে মন্ত্রী পর্যায়ের বেশকিছু পাল্টাপাল্টি সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামীতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবগুলো ক্ষেত্র সম্প্রসারণেরও সম্ভাবনা রয়েছে।’